Wednesday, August 15, 2018

-

বসন্ত এখনো সাজঘরে আমি তাই নক্ষত্রের উত্তাপ নেই শীতার্ত শরীরে। হেমন্ত বালক, তুমি নাকি অদ্ভুত বৃষ্টি নামাও.. অসময়ে ভিজিয়ে দাও চন্দ্রমল্লিকার পালক! তবু তোমার অস্তিত্ব ভূলে যায় ফসলের রাত খুব ধীরে স্পর্শ করে শীতের নগ্ন হাত.. আমলকির ডাল ঘিরে ভীড় করে কুয়াশার দল; তৃষ্ণার্ত হৃদয় পান করে মুঠো মুঠো জোছনার জল। চারপাশে ছায়ারঙা শীত আর রূপালী ঘাস.. তারপর চন্দ্রবিলাস! এক ষ্টেশনের চায়ের স্টলটাতে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কলিমুদ্দীন। দোকানি সুরুজ আলীর সাথে খোশগল্প করতে করতে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খাচ্ছিলো সে। আহ্‌, ব্যাটা জব্বর চা বানায়। মন খালি আরো খাই আরো খাই করে। কাঁচের চ্যাপ্টা বয়ামের ভেতরে সাজানো বিস্কুটগুলোকে বড়ই লোভনীয় দেখাচ্ছিলো। আলগোছেই দু’টা বিস্কুট হাপিস করার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো। সুরুজ আলীর সাথে কথোপকথনটাও চালু রেখেছে। ভাবখানা এমন যেন মনের ভুলেই হাতটা ঐদিকে চলে গিয়েছে, অন্য কিছু নয়। সুরুজ আলী খুব যত্নের সাথে হাতটা টেনে সরিয়ে দেয়। ‘কলিম ভাই, আইজগা চা খাইয়্যাই খুশি থাহো। তুমার আগের দেনাই কইলাম পঞ্চাশ ট্যাহা হইছে।’ মনে মনে কষে একটা গালি দেয় কলিমুদ্দীন। ব্যাটা শকুনের চোখ নিয়ে দোকানদারি করে। ‘আরে সুরুজ ভাই, দুইখান বিস্কুট খাইলে ফকির হইবা নি? আচ্ছা থাউক। দিয়া দিমুনি তুমার ট্যাহা...’ কথা বলতে বলতেই তার চোখ চলে যায় ষ্টেশনের শেষ মাথায় পলায়নোদ্যোত এক নারী মূর্তির দিকে। শিউলী না? এই সময় এমন ভাবে কোথায় থেকে আসছে? নাকি যাচ্ছে? ভাবসাবে তো মনে হচ্ছে কলিমুদ্দীনকে দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি পালাচ্ছে। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখেই সোজা সেই দিকে হাঁটা দেয় কলিমুদ্দীন। সুরুজ আলী পেছন থেকে ডাকতে থাকে, ‘চললা কই? চায়ের দাম দিবা না? তুমার ট্রেন তো আইয়া পড়বো এহন।’ ‘এহুনি আইতাছি। আইয়া ট্যাহা দিতাছি।’ হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয় কলিমুদ্দীন। ‘হুঃ! আর দিছো!’ শ্লেষাত্মক উক্তিটি ছুড়ে দিয়ে কাজে মন দেয় সুরুজ আলী। ব্যাটা অকর্মা কোথাকার! সাত সকালে এসে দুনিয়ার আজাইরা প্যাচাল জুড়ে দিয়েছে। চা টাও খেয়ে গেলো মুফতে। কাজের সময়ে এইসব ‘ডিস্টাব’ একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না সে। এদিকে শিউলীকে ধরার জন্য পড়িমড়ি করে ছুটেও লাভ হলো না কলিমুদ্দীনের। শিউলী একেবারে হাওয়া। ঠিক আছে, সমস্যা নাই। দুপুরে বাড়িতে ফিরে এর হিসাব নেওয়া হবে। ষ্টেশনে ফিরে আসলো সে। শুনশান নীরবতা ভাঙতে শুরু করেছে। হকার থেকে শুরু করে যাত্রী, কুলি, এমনকি ষ্টেশনের দোকানগুলো পর্যন্ত আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। একটা চটজলদি প্রাণচাঞ্চল্য যেন পেয়ে বসেছে সবাইকে। প্রতিবার ট্রেন আসার আগের মুহুর্তের এই হই-হুল্লোড় খুব ভালো লাগে কলিমুদ্দীনের। জীবন যে থেমে যায়নি এই অনুভূতিটা সে টের পায় এই সময়। আজ প্রায় কুড়ি বছর যাবত সে এই ষ্টেশনে কুলিগিরি করে আসছে। এক্কেবারে বাচ্চা বয়সে অল্প কিছুদিন ট্রেনে হকারের কাজ করেছে। সেই কাজটা বড় ভালো লাগতো তার। অন্যরকম একটা উদ্দীপনা ছিল। কাঠি লজেন্স আর চানাচুর বিক্রি করতো সে। ষ্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে যাত্রীদের ভীড় ঠেলে উঠে যেতো ট্রেনে। তার সহকর্মী অন্য হকারেরা পেরে উঠতো না তার সঙ্গে। ফুড়ুৎ করে সবার আগেই তার ট্রেনে উঠে পড়া চাই। বিক্রিও ছিলো ভালো। কাঠি লজেন্স দেখে বাবা-মা’র কাছে বায়না ধরতো না এমন কোন ছোট বাচ্চা ছিলো না। আর তার চানাচুরও ভালো বিকোতো। কিন্তু তার বাপ তাকে এই কাজ বেশিদিন করতে দিলো না। ছোটবেলা থেকেই সে ছিলো তাগড়া ধরনের। হাতে পায়ে জোরও ছিলো প্রচুর। হকারের কাজে আর কয়টাকা মুনাফা থাকে? তার বাপ তাকে কুলিগিরিতে লাগিয়ে দিলো। নিজেও সে এই কাজ করতো । বাচ্চা কুলিদের উপর মানুষের একটা সমবেদনা থাকে। অপেক্ষাকৃত কম বোঝা তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়। কিন্তু পয়সার বেলাতে আবার দু’পয়সা বেশিই দেওয়া হয়। কাজেই শূন্য পুঁজি, ডাবল মুনাফা। কিন্তু কলিমুদ্দীনের ভালো লাগতো না এই কাজ করতে। বাচ্চা কুলিদের ওপর সব যাত্রীই যে সমবেদনা দেখাতো, এমনটা মোটেও ঠিক না। কেউ কেউ বেশ দু’পয়সা ঠকিয়েও দিতো। বাচ্চা বলে প্রতিবাদের কোনো সুযোগও তো ছিলো না। এই কাজ বেশি করতো বয়ষ্ক মানুষেরা। আপাতদৃষ্টিতে যাদের প্রাণে দয়া মায়া বেশি আছে বলে মনে হয়। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরাই বরং ঠিকঠাক টাকা দিয়ে দিতো। একবার মধ্যবয়ষ্ক একজন মানুষ তাকে ভাড়া দেবার নাম করে একেবারে বাসা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো। খালি বাসায় দরজা বন্ধ করে...। তারপর সেই লোক কলিমুদ্দীনকে ভয় দেখিয়েছিলো এই বলে যে, কাউকে বললে পুলিশ উল্টো তাকেই ধরে নিয়ে যাবে। আর পুলিশ ষ্টেশনে তার উপর কী কী হতে পারে তার একটা বর্ণণাও দিয়েছিলো সেই লোক। ভয়ে কাউকে বলেনি কলিমুদ্দীন। দু’দিন কাজেও যেতে পারেনি। বাবার কাছে শরীর খারাপের অযুহাত দেখিয়েছে। এরপর থেকে সেই বাচ্চা কলিমুদ্দীনও বুঝে গেছে, দুনিয়াটা সাপ খোপে ভরা। ঠিকমত পা ফেলে চলতে না পারলে নিজের প্রাণটাই বেঘোরে চলে যাবে। কাজ করার ব্যাপারেও একটা ঢিলেমি এসে গেছে এর পরে থেকে। একটুও মন চাইতো না পরিশ্রম করতে। কীভাবে বসে বসে টাকা পয়সা কামানো যায়, সেই বয়সেই তার উপায় রপ্ত করতে শুরু করে সে। কেউ তাকে ঠকিয়ে দু’পয়সা নিয়ে যাবে, এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। প্রয়োজনে আরেকজন কে ভেঙে খাবে, কিন্তু অহেতুক খাটা-খাটনি করে মরার ইচ্ছা নাই তার। দুই শিউলী আজ জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছে। আরেকটু হলেই পড়েছিলো বাঘের মুখে। উত্তর পাড়ার টিপু শাহের বউ আজ অনেকদিন যাবত তাকে একটা কাজের কথা বলছিলো। সকাল সকাল তার বাড়িতে গিয়ে উঠোনটা লেপে দেওয়া, গোয়ালের গরু বাছুরগুলোর খাওয়ার জোগাড়যন্ত্র করে দেওয়া আর আসার আগে উঠোনে ধান-কলাই শুকাতে দিয়ে আসা। বিকেলে এক ফাঁকে গিয়ে সেই ধান-কলাই আবার তুলে রেখে আসা। এইতো এতটুকুন কাজ। আর এটুকু কাজের জন্যই গৃহস্থ তাকে নগদ পাঁচশো টাকা করে মাসে মাসে দিবে। অতি লোভনীয় কাজ। শিউলীর বড় ইচ্ছে কাজটা করার। কিন্তু তার ‘লাটসাহেব’ স্বামীর জন্য কোন কাজের নামই সে মুখে আনতে পারে না। শুনলেই একেবারে খেকিয়ে উঠে। ‘খুব কাম করনের হাউশ লাগছে মনেত, তাই না? মাইনষের বাড়িত কাম করবার যাইয়া ইজ্জত নিয়া আর বাঁচন লাগবো না। দুইডা কম খাও ক্ষতি নাই, ইজ্জত ডুবানের কাম নাই।’ হাঃ ইজ্জত! একা একা অনেক দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে শিউলী। ইজ্জতের সংজ্ঞাটা যে কী তা সে বুঝতে পারে নাই। স্বামীর কুলিগিরি’র টাকায় সংসার চলে না। ঠিকমত কুলির কাজ করলে সংসার না চলার কোনোই কারণ নাই। কিন্তু তার স্বামী পরিশ্রম করার চেয়ে শুয়ে বসে আরাম করতেই ভালোবাসে বেশি। আর জানে বড় বড় গপ্পো ছাড়তে। তার দাদা-পরদাদারা কেউ এসব বেগার খাটতো না। তাদের ছিল বিঘা বিঘা জমি। ক্ষেত ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। সেই ক্ষেতের ধান আর পুকুরের মাছ তারা নিজেরা খেয়ে কখনোই শেষ করতে পারতো না। যুদ্ধের সময় তাদের সেই বিপুল সম্পদ চলে গেছে অন্য মানুষের দখলে। এরপর থেকেই এই গরীবি দশা। হু, বিপুল সম্পদ না ঘোড়ার ডিম! বিয়ের পর প্রথম প্রথম শিউলী স্বামীর চিকনাচাকনা সব কথাই বিশ্বাস করতো। ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে, সব কথাই ভুয়া। কোন সম্পত্তি ছিল না তার শ্বশুরকূলে। এরা সাত পুরুষই ষ্টেশনে কুলিগিরি করে আসছে। রেলওয়ে জংশনের কাছে বাড়ি হওয়ায় অন্তত খাওয়া পরার একটা বন্দোবস্ত জুটেছে। না হলে যে কর্মঠ স্বামী তার! হালচাষ তো তাকে দিয়ে জীবনেও হতো না। কিন্তু এতদিন তাও যা হোক কিছু একটা করে দিন চলে যেতো। গতবছর ছেলেটা জন্মাবার পরে থেকে খরচ বেড়ে গেছে। ছেলের দুধ কিনতে হয়। ঠিকমত বুকের দুধ পায় না, দু’মাসের পর থেকেই বাচ্চাকে তোলা খাওয়াতে হয়। তাই খরচে আর কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। এখানে ওখানে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। শিউলী জানে, তার স্বামী কোনদিনই এসব দেনা মিটাতে পারবে না। এখনো লোকজন ধার দিতে অপারগতা জানাচ্ছে না, কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সেই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হবে না। এই তো, গত মাসে ট্রাক ড্রাইভার কুতুব মিয়া এসেছিলো ধারের টাকা ফেরত চাইতে। কলিমুদ্দীন বাড়িতে ছিল না বলে রক্ষা। থাকলে মনে হয় ভালোই একটা ঝামেলা বাঁধতো। কুতুব মিয়া আবার আসবে বলে সেদিনের মতো বিদায় নিয়েছে। যাওয়ার সময় চোখের আশ মিটিয়ে একটা নির্লজ্জ দৃষ্টি দিয়ে গেছে শিউলীর দিকে। শিউলীর ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে সেই চোখের চাউনি। এই লোক তো মনে হয় না সহজে পিছু ছাড়বে। তাছাড়া তার স্বামী আর মানুষ পেলো না? একজন ড্রাইভারের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হবে! সেদিনের কথা শিউলী স্বামীকে বলতে ভোলে নাই। সেই চোখের চাউনী পর্যন্ত। কিন্তু কলিমুদ্দীন নির্বিকার। এসব নাকি শিউলীর মনের ভুল। একটা বড় কাজ পেলেই সব দেনা চুকিয়ে দেবে, এমন আশ্বাস বাণীতে ভরসা পায়নি শিউলী। চব্বিশ ঘণ্টা ভয়ে থেকেছে কখন না জানি আবার কুতুব মিয়া চলে আসে! বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নাই। গত পরশুদিনই আবার হানা দিয়েছে সে। এবার একেবারে ঝেড়ে কেশেছে কুতুব মিয়া। ‘জামাইরে কও হয় ট্যাহা দিক, নয়তো বাড়িত বন্ধক দেওনের কিছু থাগলে হেইডা দিক। হেহ্‌ হে...।’ সেদিনের পর থেকে আর শান্তিতে নাই শিউলী। তার স্বামীর উপর ভরসা করে কাজ নাই। যা করার তাকেই করতে হবে। তাই সে আজ গিয়েছিল টিপু শাহের বাড়ি। সকাল সকাল কাজ করে চলে আসবে। সেই সময়ে তো কলিমুদ্দীন বাসায় থাকে না। তার স্বামী জানতে না পারলেই হলো। বাচ্চাটাকে সাথে নিয়েই যাবে। ছেলেটা বড় শান্ত হয়েছে তার। কান্নাকাটি একেবারেই করে না। যেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানেই বসে থাকে। টিপু শাহের বউ তাকে কাজে রেখেছে। দুইশো টাকা অগ্রিমও দিয়েছে। সবকিছুই ঠিক ছিল। ফেরার পথে ষ্টেশনের ভেতর দিয়ে শর্টকাট মারতে গিয়েই ভেজালটা বেঁধেছে। কেন যে এত বড় ভুলটা করতে গেলো! তবে মনে হয় কলিমুদ্দীন তাকে দেখতে পায়নি। এই যাত্রায় বেঁচে গেছে সে। কাজটা করবে শিউলী। একটু একটু করে টাকা বাঁচিয়ে মিটিয়ে দেবে কুতুব মিয়ার সব পাওনা। ঘরের বাইরে গিয়ে ইজ্জত হারানোর আশংকা করছে তার স্বামী। কিন্তু ঘরে বসে থেকে ইজ্জত বাঁচারও তো কোন সম্ভাবনা দেখছে না শিউলী। ফুটবল খেলাটি বাঙালির নিজস্ব খেলার তালিকায় নেই। তবুও বাংলা অঞ্চলে ফুটবলকে নিছক ছেলেখেলা হিসেবে দেখা মুশকিল। কারণ ধীরে ধীরে বিদেশি এই খেলাটি মিশে গেছে আমাদের জীবনযাপন, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে। তাই ফুটবল নিয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাস শুরু থেকেই। বাঙালি লেখকদের লেখাজোকায়ও নানাভাবে এসেছে ফুটবলের প্রসঙ্গ। প্রমথ চৌধুরী ১৯১৫ সালে রচিত তাঁর ‘সাহিত্যে খেলা’ নামের এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যবিহীন।’ ওই প্রবন্ধে তিনি ‘উদ্দেশ্যবিহীন’ বলতে আনন্দদায়ক বোঝাতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, খেলা উদ্দেশ্যবিহীন এবং আনন্দদায়ক বলেই কলকাতার টাউন হলের দেশহিতকর বক্তৃতার চেয়ে ‘গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে’ মানুষ বেশি যায়। খেলা সম্পর্কে, বিশেষত ফুটবল খেলা সম্পর্কে, প্রমথ চৌধুরীর এই বক্তব্য খুবই সরল এবং বাছবিচারহীন বলেই মনে হয়। বাংলা অঞ্চলে ফুটবল খেলাকে ছেলেখেলা হিসেবে দেখা খুব মুশকিল। বাংলায় ফুটবলের সাংস্কৃতিক-রাজনীতি আছে, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার আছে, আছে শ্রেণিচরিত্র। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঙালির খেলাধুলার-সংস্কৃতির এন্তার বর্ণনা আছে। প্রাচীন সাহিত্য ঘেঁটেঘুঁটে দেখা যায়, আদিতে শিকার বা মৃগয়া বাঙালির খেলার একটা অংশ ছিল। নিম্নবর্গের বাঙালিদের কাছে শিকার ছিল জীবিকা ও ক্রীড়া দুই-ই। উচ্চবর্গের কাছে এটি ছিল শুধুই খেলা। বাংলা সাহিত্যের ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্য-এর ‘কালকেতুর বাল্যক্রীড়া’ উপশিরোনামে দেখা যায় সেখানে খেলা ও শিকার সমার্থক। কবির ভাষায়, ‘শিশুগণ সঙ্গে ফিরে, তাড়িয়া শশারু ধরে/দূরে পশু পালাইতে নারে।/বিহঙ্গ বাট্যুলে বধে/লতাতে জড়ায়ে বান্ধে/কান্ধে ভার বীর আস্যে ঘরে।’ শুধু মধ্যযুগের নায়ক কালকেতু কেন, বাংলাদেশে বর্তমানে জীবিত পুরোনো প্রজন্মের যাঁরা আছেন, তাঁরাও নিশ্চয় জানেন, শিকার তাঁদের কাছে একটা আনন্দময় খেলাই ছিল বটে। বাঙালির খেলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস বইয়ে বলেছেন, ‘কুস্তী বা মল্লযুদ্ধ এবং নানাপ্রকারের দুঃসাধ্য শারীর-ক্রিয়া ছিল নিম্ন কোটির লোকদের অন্যতম বিহার (পড়ুন: খেলা)। পবনদূতে নারীদের জলক্রীড়া এবং উদ্যান রচনার উল্লেখ আছে; এই দুটিই বোধ হয় ছিল তাঁহাদের প্রধান শারীর-ক্রিয়া। দ্যূত বা পাশাখেলা এবং দাবা খেলার প্রচলন ছিল খুব বেশি। পাশাখেলাটা তো বিবাহোৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ বলিয়াই বিবেচিত হইত।’ (পৃ. ৪৪৯)। দাবা খেলার প্রসঙ্গ তো বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ-এ হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যযুগের সাহিত্যে লাঠিখেলা, ঘোড়দৌড়ের উল্লেখও বেশ দেখা যায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ফুটবল খেলাটা বাঙালির নিজস্ব খেলার তালিকায় নেই। খাঁটি বাংলায় বলতে গেলে বাংলায় ফুটবলের ইতিহাস শুক্কুরে শুক্কুরে সাত দিনের ইতিহাস। বাংলামুলুকে ফুটবল খেলাটা ঢুকেছে মূলত ইংরেজ উপনিবেশের হাত ধরে। ইংরেজ রাজ-কর্মচারীরা তাঁদের বিকেলের সময় কাটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে এই খেলাটা খেলত। এক এলাকার রাজ-কর্মচারীরা অন্য এলাকার রাজ-কর্মচারীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে প্রতিযোগিতারও আয়োজন করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে (১৮৫৪-এর পর থেকে) কলকাতা ও ভারতের অপরাপর অঞ্চলে এই খেলার খেলোয়াড় এবং দর্শক দুটোই ছিল ইংরেজ। ক্রমে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলার ইংরেজ-সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণি। আরও পরে দর্শক হিসেবে ‘সাধারণ মানুষের’ সমাগম ঘটতে থাকে। তবে এই ‘সাধারণ’ বলতে নিশ্চয় খেটে খাওয়া মানুষ না। এই ‘সাধারণের’ও একটা শ্রেণি-পরিচয় ছিল। তারা অবশ্যই সেই শ্রেণি, যারা এ দেশে ইংরেজ শাসনের স্থানীয় খুঁটি হিসেবে কাজ করত অথবা পড়ালেখা শিখে যারা কালো চামড়ার ইংরেজ হয়ে উঠতে চাইত। হেয়ার স্কুলের ছাত্র ও ‘অভিজাত’ বংশের ছেলে নগেন্দ্রপ্রসাদের হাত ধরে ফুটবল বাঙালির মধ্যে খেলা হিসেবে প্রবেশ করে। হেয়ার স্কুলের এই ছাত্রটি নিশ্চয় ইংরেজ অনুকরণের মনোস্তত্ত্ব থেকে এ খেলাটা শিখতে চেয়েছিলেন। ১৮৮৪ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদ যখন তাঁর সমমনা বন্ধুদের নিয়ে ডালহৌসি ফুটবল ক্লাব গঠন করছেন, তার আগের দশকে বাঙালির ইংরেজ অনুকরণ নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) প্রমুখ রচনা করেছেন অসাধারণ অসাধারণ সব প্রহসন। যা হোক, নগেন্দ্রের ডালহৌসি ফুটবল ক্লাব বেশি দিন টেকেনি। অগত্যা ১৮৮৫-তে ‘শোভাবাজার ক্লাব’ নামে তিনি আরেকটি ক্লাব গঠন করেন। ক্লাবের নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইংরেজের ফুটবল কীভাবে স্থানীয় হয়ে উঠছে। ১৮৮৯-তে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আরেকটি স্থানীয় ক্লাব—মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব। শোভাবাজার ক্লাব ১৮৯২ সালে যখন ট্রেসড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ইংরেজ ক্লাব ‘ইস্ট সারে রেজিমেন্ট’কে হারিয়ে দেয়, তখন বাংলায় ফুটবলের নতুন মানে দাঁড়ায়। আরও নতুন মানে দাঁড়াল ১৯১১-এ, মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন শিল্ড কাপ জেতার পর। ফুটবল সে সময় আর নিছক ইংরেজ-অনুকরণের বিষয় হিসেবে না থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়। ১৯১১ সালের ২৯ জুলাইয়ের সেই ইংরেজ-বাঙালি খেলায় মানুষের ঢল নেমেছিল। এমনকি ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে হাজার হাজার মানুষ সেদিন গিয়েছিল কলকাতার সেই খেলা দেখতে। কেন গিয়েছিল? ওই দলের ১১ জনের ১০ জনই পূর্ব বাংলার খেলোয়াড় ছিল সে জন্য? শুধু তাই নয় বোধ হয়। তারও চেয়ে বেশি কিছু। এর অন্যতম কারণ বোধকরি স্বামী বিবেকানন্দের ফুটবল-সম্পর্কিত সেই বাণী, ‘পদাঘাতের বিপরীতে পদাঘাত কেবলমাত্র ফুটবলেই সম্ভব।’ ফুটবল সেদিন হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকাশের দারুণ এক অস্ত্র। ফুটবল খেলা সেদিন আর প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় শুধু ‘উদ্দেশ্যবিহীন’ আনন্দদায়ক খেলা রইল না, হয়ে উঠল ‘প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার’। ফুটবল যে সেই কালে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আবেগের বিষয় হয়ে উঠেছিল, এ কথা বিখ্যাত ঐতিহাসিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর ব্লাক হোল অব এম্পেয়ার (২০১২) বইয়ে সবিস্তারে দেখিয়েছেন। কথিত আছে ১৯১১-এ বঙ্গভঙ্গ যে রদ হয়েছিল, ফুটবলকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেই জাগরণ এর অন্যতম কারণ। হয়তো এ কথা মিথ, মানে মিথ্যার মতো, কিন্তু সত্যের চেয়েও বেশি সত্য। ১৯১১ সালের মোহনবাগানের জয় বাঙালির মধ্যে এত গভীর দাগ কেটেছিল যে এই জয় নিয়ে ১৩১৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যার মানসী পত্রিকায় করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এক কবিতা লেখেন। কবিতার একাংশ এরূপ,Ñ‘জেগেছে আজ দেশের ছেলে পথে লোকের ভীড়,/অন্তঃপুরে ফুটল হাসি বঙ্গরূপসীর।/গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,/আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।/আজকের এই বিজয়বাণী ভুলবে নাকো দেশ,/সাবাশ সাবাশ মোহনবাগান খেলেছ ভাই বেশ।’ এই কবিতাটি পরে গান আকারে গীত হয় এবং কলকাতায় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯১১-এ বাঙালির হাতে ইংরেজ যখন ফুটবলে পরাজিত হলো, কাজী নজরুল ইসলামের বয়স সে সময় ১২ বছর। তখন দারিদ্র্যের সঙ্গে অভাবনীয় সংগ্রামে রত এক কিশোর তিনি। এই কিশোর আর মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে ইংরেজের ভিত-কাঁপানো সব কাব্য-কবিতায় ভরিয়ে তুললেন বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার। ১৯২০-এর দশকের প্রায় পুরোটা সময় নজরুলের কেটেছে মূলত প্রবল ইংরেজ বিরোধিতায়। তাঁর বইয়ের পর বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জেল খেটেছেন ইংরেজবিরোধী কবিতা লেখার দায়ে। এই কবি যদি দেখেন আধিপত্যবাদী শোষক ইংরেজকে কোনো ফুটবল খেলায় বাঙালি ছেলেরা পরাজিত করেছেন, তখন তিনি কেমন উন্মাদনা বোধ করতে পারেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। সালটি ১৯২৮। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়। সেবার মোহনবাগান ক্লাব এক ইংরেজ ফুটবল ক্লাবকে (ডিসিএলআই?) পরাজিত করে। ইংরেজ উৎখাতই যাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়, তিনি বাঙালির এই জয়ে সৃষ্টিছাড়া আনন্দে ভাসবেন—এ আর নতুন কী! ফলে সেদিনের সেই জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন। উদ্দেশ্য ইংরেজ-বধ উদ্‌যাপন! কল্লোল যুগ বইয়ে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘সুতরাং খেলার মাঠ থেকে সোজা শেয়ালদা এসে ঢাকার ট্রেন ধরল তিনজন। দীনেশরঞ্জন, নজরুল আর নৃপেন।’ (পৃ. ১২৬)। কারণ হিসেবে অচিন্ত্য বলেছেন, ইংরেজের বিরুদ্ধে সেই খেলায় ঢাকার ছেলে মনা দত্ত বা রবি বোস বেশ কয়েকটা গোল দিয়েছিলেন। অচিন্ত্যের ভাষায়, ‘ঢাকার লোক যখন এমন একটা অসাধ্য সাধন করল তখন মাঠ থেকে সিধে ঢাকায় চলে না যাওয়ার কোনো মানে হয় না। যে দেশে এমন একজন খেলোয়াড় পাওয়া যায় সে দেশটা কেমন দেখে আসা দরকার।’ (পৃ. ১২৬)। আদতে সৃষ্টিছাড়া এক আনন্দে আত্মহারা হয়েই তিনি ঢাকা এসেছিলেন। গোলাম মুরশিদ তাঁর বিদ্রোহী রণক্লান্ত (২০১৮) বইয়ে নজরুলের সেবারের হঠাৎ ট্রেনে চেপে ঢাকা আসা সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিজের পরিবারকে বলে যাওয়ার বালাই নেই, সওগাতকে জানানোর দরকার নেই, প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। দায়িত্বহীনতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার দৃষ্টান্ত বটে।’ (পৃ. ৩১৮)। কিন্তু সত্যিই কি এটা ‘দায়িত্বহীনতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা’! নাকি ইংরেজ-বধের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ! ইংরেজকে ফুটবলে পরাজিত করার মধ্যে কি নজরুল তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন মাতৃভূমির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেখে আত্মহারা হয়েছিলেন! ব্যক্তিটি যখন নজরুল তখন তাই হওয়াটাই তো স্বাভাবিক! ফুটবল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যেমন শাণিত করেছে তেমনি বিতর্কও কম তৈরি করেনি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফুটবল এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে সাহিত্যে খেলার প্রসঙ্গ মানেই ফুটবল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শ্রীকান্ত (১৯১৭) উপন্যাসে ফুটবল খেলার এক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ। সন্ধ্যা হয় হয়। মগ্ন হইয়া দেখিতেছি। আনন্দের সীমা নাই। হঠাৎÑ ওরে বাবাÑএ কি রে! চটাপট্ শব্দ এবং মারো শালাকে, ধরো শালাকে!...পাঁচ-সাতজন মুসলমান-ছোকরা তখন আমার চারিদিকে ব্যূহ রচনা করিয়াছেÑপালাইবার এতটুকু পথ নাই।’ (শ্রীকান্ত, প্রথমপর্ব, পৃ.Ñ২) শরতের এই ‘বাঙ্গালী’ এবং ‘মুসলমান’ দল বিভাজন উত্তরকালে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি শরৎচন্দ্র মুসলমানদের বাঙালি মনে করতেন না! নাকি শরৎচন্দ্র সমকালের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছিলেন মাত্র। এ এক ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়ই বটে! মিলন আর দ্বন্দ্ব যা-ই সৃষ্টি করুক না কেনো বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে ফুটবল খেলা বাংলা অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বর্তমানে ফুটবল গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে প্রবেশ করলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে অবিভক্ত বাংলায় ফুটবল ছিল মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকর্ষণীয় খেলা। ফুটবল যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির খেলা ছিল তা জসীমউদ্‌দীনের হাসু (১৯৩৮) কাব্যগ্রন্থের ‘ফুটবল খেলোয়াড়’ কবিতা দেখলেই বোঝা যায়। এই কবিতায় দেখা মেলে জসীমউদ্‌দীনের কাব্য-কবিতার মধ্যে সবচেয়ে ‘স্মার্ট’ নায়ককে—ইমদাদ হক। সোজন, রূপাই নামের বিপরীতে এই নাম ‘স্মার্ট’ আর নির্দিষ্ট শ্রেণি-চিহ্নিতই বটে। আবার এই যুবক থাকেও শহরের ‘মেসে’। কবির ভাষায়, ‘আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়।’ সমকালের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ফুটবল কী এক তীব্র উন্মাদনা ছড়িয়েছিল তার এক বিশ্বস্ত ছবি পাওয়া যায় এই কবিতায়। ইমদাদ হককে সকালবেলা গিঁটে গিঁটে মালিশ আর সেঁক দিতে দিতে মেসের চাকর ‘লবেজান’ হয়ে যায়। সবাই ভাবে ইমদাদ ‘ছমাসের তরে পঙ্গু যে হল হায়’। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় দেখা গেল ‘বাম পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা,/ভাঙা কয়খানা হাতে-পায়ে তার বজ্র করিছে খেলা।’ ফুটবল আনন্দদায়ক খেলা—এটা যেমন সত্যি, তেমনি এ-ও সত্যি যে ফুটবলের সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক-রাজনৈতিক পরিচয় আছে। আছে সাহিত্যের অন্দরমহলে হানা দেওয়ার মতো অসামান্য ক্ষমতা। আছে প্রবল সম্মোহনী শক্তি। আপাত নিরীহ এই খেলাটার মধ্যে আছে ইতিহাসের সরল-জটিল সব অলিগলি আর আলো-আঁধার। তিন গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে একটা কথাও বলে না কলিমুদ্দীন। আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। তারপর আয়েশ মতো একটা বিড়ি ধরিয়ে ডাক দেয় শিউলীকে। ‘আইজ কই গেছিলি?’ চমকে ওঠে শিউলী। ও, তাহলে নজর এড়ায় নাই। এইসব দিকে নজর ঠিকমতো আছে। জানে সে, মিথ্যা বলে লাভ নেই কোনো। তাই মাথা সোজা রেখেই বলে, ‘টিপু শাহের বাড়িত গেছিলাম। কামডা নিছি আমি।’ ‘এঃ! কামডা নিছি আমি! তুই নেওনের মালিক হইলি কুন্দিন থনে? আমি করবার দিমু ভাবছোস? ঐ টিপু শাহ্‌ লোক কেমুন জানোস কিছু?’ ‘হেইডা জাইন্যা আমার কী? আমি আমার কাম কইর্যান চইল্যা আইমু।’ ‘এঃ! কাম কইর্যাস চইল্যা আইমু! তোরে আইবার দিলে তো! আমের আঁঢির লাহান চুইষ্যা খাইবো, বুঝছোস?’ ‘আর, ঘরেত বইয়্যা থাহলে আপনের ডেরাইভার আমারে চুইষ্যা খাইবো।’ ‘খালি মুহে মুহে কতা। আমি করবার দিমু না। ব্যস, এইডা আমার শ্যাষ কথা। এর পরেও যুদি করার ইচ্ছা থাহে, তোরে আমি তালাক দিমু।’ এইটা শুনে আর কথা সরে না শিউলী’র মুখ থেকে। একেবারে বোবা হয়ে যায় সে। ওদের চেঁচামেচিতে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে বাচ্চাটা। শিউলী দৌঁড়ে গিয়ে বুকে নেয় তাকে। মায়ের বুকের ওমে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে। কলিমুদ্দীন দুমদাম দাম্ভিক পা ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সেদিন বিকেলেই একটা ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটে। চলমান ট্রেন থেকে যাত্রীর কাছ থেকে মাল-সামান নিতে গিয়ে অসাবধানে কলিমুদ্দীনের একটা পা চলে যায় ট্রেনের চাকায়। চোখের পলকেই পা টা একেবারে থেঁতলে যায় তার। ষ্টেশনের বিপুল কোলাহল আর শোরগোলের মাঝেই ভীষণরকম বেমানানভাবে অসার, নিঝুম হয়ে আসে কলিমুদ্দীনের জগতটা। চার ডান পা টা কেটে ফেলতে হয় কলিমুদ্দীনের। শুরু হয় তার অন্য জীবন। হাতে সামান্য যে ক’টাকা গচ্ছিত ছিল, চিকিৎসা বাবদ সেটাও চলে যায়। পুরোপুরি পথে বসে যায় পরিবারটি। এক কামরার ছোট্ট যে বাসায় তারা থাকতো তার যৎসামান্য ভাড়া মেটানোও আর সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। বাকী পড়ে যায় বেশ কয়েক মাসের ভাড়া। বাড়িওয়ালা প্রথম কিছুদিন এসে উহুঁ আহা করে যায়। আস্তে আস্তে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একসময় ভাড়া দেওয়ার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে। বাচ্চাটার দুধ কেনা হয় না। ঠিকমত ভাতই জুটে না এখন, আর দুধ! ভাতের ফেন, একটু সুজি....যখন যা পারে তাই খাওয়াতে শুরু করে বাচ্চাটাকে। একবছরের শিশুও বুঝি বুঝে যায় যে, এখন মর্জি করলে চলবে না। তাই যা পায়, সেটুকুই চেটেপুটে খেয়ে নেয়। এর মধ্যে গজবের মতো একদিন এসে উপস্থিত হয় ড্রাইভার কুতুব মিয়া। কলিমুদ্দীনকে পেয়ে খিস্তি খেউড়ের মাতম উঠায়। এতদিন ধরে ধার নিয়ে বসে আছে। তার টাকা মেরে খেলে সে কলিমুদ্দীনকে জানে মেরে ফেলবে এই হুমকিও দিয়ে যায়। ফেরার পথে উঠোনে একা পেয়ে শিউলীর কানে কানে বলে যায়, ‘ল্যাংড়া জামাই লইয়্যা আর কী ঘর করবা গো সুন্দরী? কুপ্রস্তাব দিতাছি না। ভাইব্যা দেহো। বিয়্যা করমু তুমারে। রাজি থাগলে কও। তুমার জামাইয়ের দেনাও মাফ কইর্যা দিমু তাইলে। এই লও আমার ঠিহানা। বাচ্চা নিয়্যা আইলেও রাজি আছি।’ শিউলী ছুটে ঘরে এসে জামাইয়ের অবশিষ্ট পা টা চেপে ধরে। ‘আপনার দুহাই লাগে। আমারে এইবার কাম করনের অনুমতি দ্যান। নাইলে আমরা কেও বাঁচবার পারুম না। আপনি আমার লাইগ্যা চিন্তা করবেন না। আমি বাঁইচ্যা থাকতে আমার ইজ্জত খুইতে দিমু না। আমারে আপনি কাম করবার দ্যান। আমার বাচ্চাডারে বাঁচাইবার দ্যান।’ কলিমুদ্দীন দার্শনিকের মতো বলে, ‘বউ, ইজ্জত হইলো বেবাকের আগে। এইডা বুঝোন লাগবো। মাইনষ্যের বাড়িত কাম করলে হেই ইজ্জতের কিছুই বাকি থাগবো না। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি উপায় ভাইব্যা থুইছি। কাল থিইক্যা ইস্টেশনে বসমু আমি। গ্যাদারে লগে দিও। মাইনষ্যে ছোডো বাচ্চা দেহলে ট্যাহা দিইয়্যা ভরাইয়্যা দেয়। তুমি বাড়িত বইস্যা ট্যাহা গুইন্যা শ্যাষ করবার পারবা না।’ শিউলী বিষাক্ত চোখে তাকায় কলিমুদ্দীনের দিকে। ভাগ্যিস, সেই দৃষ্টির ভাষা পড়বার মতো যোগ্যতা কলিমুদ্দীনের নেই। পরদিন সকাল বেলাতেই কলিমুদ্দীন একটা মাদু্র আর টাকা রাখবার একটা ডিব্বা নিয়ে ষ্টেশনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। চিকিৎসার সময় সদর হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব তাকে দয়া করে একজোড়া পুরনো স্ক্র্যাচ দিয়েছিলেন। সেটার সাহায্যেই সে বেশ একা একা চলতে পারে। যাওয়ার আগে শিউলীকে বলে যায়, ‘ও বউ, আমি যাইতাছি। তুমি এট্টু পরে গ্যাদারে লইয়্যা যাইয়ো।’ শিউলী তাকিয়ে তাকিয়ে তার স্বামীর চলে যাওয়া দেখে। পরাজিত, জীবন থেকে পলায়নকারী একজন মানুষ। অথচ, তার চালচলনে এখনো কেমন ইজ্জতের বড়াই! ঠিকই তো, ইজ্জতটা চলে গেলে আর কী থাকবে? শিউলী নিজেও তৈরি হয়ে নেয়। বিয়ের সময়ের টিনের ট্রাঙ্কটা বের করে ওর কাপড়গুলো গুছিয়ে নেয়। বাচ্চাটার কাপড়গুলোও ভরে নেয়। শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখে স্বামীর বাড়ির দিকে। ওর নিজের হাতে গোছানো সংসার, হাড়িকুড়ি, চুলার পাড়, দেয়াল ঘেঁষে ওরই হাতে লাগানো পুঁইয়ের চারা। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে। তিনরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে যায় শিউলী। রাস্তা ঘুরে গেছে তিন দিকে। তার বাপের বাড়ির পথ চলে গেছে ডানদিকে। আসা যাওয়া নাই কতদিন! কী জানি! রাস্তাটা আগের মতোই হাঁটার যোগ্য আছে, নাকি খানাখন্দে ভরে গেছে! বাঁয়ের সরু পথটা যে গন্তব্যে গেছে সেই ঠিকানা তার হাতে্র মুঠোয় ধরা। এই পথে কোনোদিন চলেনি সে। ঠিকঠাক পথের দিশা খুঁজে পাবে কিনা তা তার অজানা। সামনের সোজা পথটা অনেক চওড়া, সমতল...এতটুকুও বন্ধুর নয়। হাতছানি দিয়ে শিউলীকে যেন ডাকছে সে পথ। কিন্তু শিউলীর জানা নেই সেই পথের শেষে সে কোন গন্তব্যের দেখা পাবে। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাতে থাকে সে। পথচলতি দু’চারজন মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে। একেকজনের চোখে একেকরকম প্রশ্ন। সব প্রশ্নের ভাষা একেবারে অজানা নয় শিউলীর। বাচ্চাটার মুখের দিকে পূর্ণচোখে একবার তাকায় সে। একটা কোনো ইঙ্গিতের আশায়। বেশি সময় নেওয়া যাবে না। খুব তাড়াতাড়িই একটা পথ তাকে বেছে নিতে হবে। ভ্যাপসা আচমকা বৃষ্টিটা থেমে গেল। এরপরেই শুরু হল মেঘের গর্জন। কিছুক্ষন পর সব কিছু পরিস্কার। বৃষ্টির জন্য রাস্তার মাঝে পানির গড় উচ্চতা ছিল ১০ মিমি। কোথা থেকে একটা কাক এসে যেন পানির মাঝে কি খোঁজা শুরু করল। মেয়েরা আংটি হারালে যেরকম করে খুঁজে। কিন্তু কাকের তো আংটি নেই সে কি খুজবে পানির মাঝে ! এই বিষয়টা নিয়ে মেয়েটা খুব কৌতূহলী এবং বিরক্ত। কারন সে জানতে পারছে না কাকটা কি খুজছে। কাকের কান্ড কারখানার দর্শকই হচ্ছে আমার গল্পের নায়িকা। চোখের মাঝে যেন একটা বিল ঢুকে আছে। চাহনি দিয়েই সম্মোহনের এক অপূর্ব ক্ষমতা রাখে সে। খুব অল্প কিছু মানুষই তাদের জীবনে এরকম অদ্ভুত সুন্দর কারো দর্শন পায়। এমনই অপূর্ব রূপবতী ছিল আমার গল্পের নায়িকা। যারা বর্ণনা গুলো পরে আগ্রহ পাচ্ছেন তাদের জন্য দুঃখিত। কারন মেয়েটা এরকম বিশেষ সুন্দরী কিছুই ছিল না। ইটের দেয়াল পুরানো হয়ে গেলে তার উপরে যেমন একটা ভ্যাপসা রঙ পরে মেয়েটার রঙ ছিল সেরকমই। শ্যামলার চাইতে নিচে। চেহারায়ও বিশেষ সুন্দরের কোন ছাপ ছিল না। গল্প এদ্দুর পরে অনেকেই রেখে দেবেন, কারন কুৎসিত মেয়েদের নিয়ে গল্পগুলো কল্পনা করতে এক ধরনের অস্বস্তি লাগে। বিরক্তি হয়। সৌন্দর্য অনেক বড় একটা ব্যাপার। তাই গল্পের নায়িকাগুলো চমৎকার সুন্দরী হয়। লোকে আগ্রহ পাবে তবে। শিল্পির অনেকদিন ধরেই একটা ইচ্ছে ছিল; একটা সাদা শাড়ি কিনবে। কারন সেবারের পহেলা বৈশাখে সাদা শাড়ি লাল পারের একটা শাড়ি দেখেছিল একটা মেয়ের গায়ে। আগে সাদা শাড়ি দেখলেই বিধবা সাইন মনে হত, কিন্তু মেয়েটার গায়ে শাড়িটা দেখে তার এতটা ভাল লেগেছিল যে সে এই জিনিসটা নিয়ে বেশ কয়েকবার সপ্নও দেখেছে। প্রথম স্বপ্নটা ছিল শিল্পি সাদা শাড়ি পরে কাশফুলের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে । কে তার চেহারাটা বুঝে উঠা মুশকিল। এক ধরনের লুকোচুরি খেলা। কিন্তু ছেলেটা একটু বোকা টাইপের, সে শিল্পিকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর কিছু সময় পরে পরেই অস্থির হয়ে উঠছে। শিল্পির জীবনে এটাই প্রথম সপ্ন যেটা সে অনেক সময় ধরে মনের আশ মিটিয়ে দেখতে পেরেছিল।সাদা শাড়ির কথা শিল্পি মাকে অনেক বলেছিল। কিন্তু মা বিশেষ পাত্তা দেয় নি। শিল্পীর মা আসলে তাকে বুঝাতে চাচ্ছে না যে সাদা শাড়িতে শিল্পিকে মোটেই ভাল লাগবে না। কারন সাদা শাড়ির আড়ালে ভ্যাপসা কেউ। মোটেই মানাবে না। অনেক কৌশল করেও শিল্পীর মা তাকে সেটা বুঝাতে পারে নি। যদি তার অনেক টাকা থাকত তাহলে সে মেয়েটাকে অবশ্যই সাদা শাড়ি দিত। এমনকি না মানালেও। কিন্তু যাদের কাছে অনেক টাকা থাকে না তাদের কে বেছে বেছে কিনতে হয়। মানানো না মানানোর বিষয়গুলো নিয়ে অনেক ভাবতে হয়। অথচ ২৪ বছরের এই মেয়েটাকে সেই সহজ কথাটা বুঝানো যাচ্ছে না। বিয়ে করালে ঠিক সময়ে এখন এর একটা বাচ্চা থাকত।– মা, জান কালকে রাত্রেও সপ্নে দেখি আমি সাদা শাড়িতে, একটা নৌকার উপরে । চারিপাশে পানি আর পানি , চলন বিল।– তোর বয়স কত?– ২৪-২৫ ক্যান?-আমি এরকম সপ্ন দেখতাম ১৫ বছর বয়সে। তোর মাথায় কি কিছু নাইরে শিল্পি। এত বড় হইছস। কি অবস্থা সংসারটার। আর তার মইদ্ধে…-থাক হইছে, আর চিল্লাফাল্লা কইরো না, তোমার চিল্লাফাল্লায় কান ঝালাফালা হইয়া যায় ।শিল্পির মা কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। শাহানা বেগমের তিন মেয়ে। শিল্পি মেঝ। অথচ তার আচরণে মনে হয় সেইই যেন সবার ছোট। শিল্পীর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট বোনটা তার স্কুলের এক ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। সংসারে এখন শুধু শিল্পীই একা। শাহানা বেগমের এই বয়সে এসে কাউকে নিজের সাথে সাথে সবসময় রাখতে ইচ্ছে করে। শিল্পীর বিয়ে নিয়ে তাই তার বিশেষ কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু তারপরেও মাথা ব্যাথা আনতে হয়। কারন মেয়েটার বয়স হয়ে যাচ্ছে। এর যদি এখন বিয়ে দেয়া না যায় ……… । ‘ মেয়েটা আমার একটু রংচটা বলে………… মানুষ কে কি শুধু চেহারার সুন্দর দিয়েই বিবেচনা করা যায় ! ? ? মনের কি কোনই দাম নে ই !’ খুব সম্ভবত যাদের চেহারা সুন্দর না তারাই এমনটা ভাবে।এত অসৌন্দরযের মাঝেও, কেউ হয়ত সত্যিই শিল্পীর সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিল। যাকে সে প্রায়ই সপ্নে দেখত, কিন্তু কখনই মানুষটার সম্পূর্ণ মুখ দেখে উঠতে পারে নি। হয়ত তাকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ একজন যদি সৌন্দর্য খুঁজে নাইই পায় তবে প্রকৃতির উদ্দেশ্য সফল হবে কি করে। প্রকৃতি সবসময়ই একটা বন্ড পেয়ার তৈরি করে। আমাদের জীনের এলিলে এক্স আর ওয়াই এর শতকরা মান ৫০% করে। কিছু মারাত্মক রকম স্বার্থপর জীনকে ট্রান্সফারের জন্য প্রকৃতি আমাদের প্রোগ্রাম করে রাখছে, এখানে সে প্রত্যেকের জন্যই কোন না কোন একজনকে ঠিক করে রেখেছে। সেই ঠিক করা মানুষটাকে শিল্পী চিনে উঠেও চিনতে পারছে না।স্বভাবতই যৌবনে প্রেম ভালবাসা করতে না পারার কারনে শিল্পীর মনের প্রেমের অতৃপ্ত শুন্য স্থানটা আরও গভির হতে থাকে। এই কারনেই পাঁচ টাকার নোটের উপরে লিখা নিঃস্বার্থ প্রেমিকদের নাম্বারে তাকে প্রায়ই ফোন করতে দেখা যায়। এদের সাথে শিল্পীর কথাবার্তা খুব একটা এগোয় না। কারন এই নিঃস্বার্থ প্রেমিকরা ছেঁচোড়ের দলে। শিল্পী এখনো তাদের মত হতে পারে নি। কিন্তু চারিদিক তাকে ক্রমশই ছেঁচোড় করে তুলছে। এখন হয়ত অনেকের সাথে ১০ মিনিট বেশি গ্যাজাত দেখা যায় ফোনে। কারন যেই মেয়ে প্রেমের জন্য ছেলেদের নাম্বারে ফোন দিয়ে দিয়ে বেড়ায় সে ছ্যাঁচোড় না হয়ে যায় কোথায় !শিল্পীর বাবা নিষ্কর্মা মানুষ। তিন সন্তান জন্ম দানের পর চারিপাশের রঙ্গমঞ্চ দেখে নিজে থেকেই চুপসে গেছে। বাসায় ঢুকলে তার কাছে সবসময়ই চিড়িয়াখানা থেকে দুই আনা ভাল কিছু মনে হত না। কিন্তু সেই চিড়িয়াখানা আজ শ্মশান খানায় পরিনত হয়েছে। সেই শ্মশান খানা থেকে মাঝে মাঝে হয়ত ভ্যাপসা কারও ফোনে কথা বলার শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্বের নিস্করমতা তাকে এখনও গ্রাস করে আছে। ছ্যাপলার মত সব ব্যাপারেই তাকে হাঁসতে দেখা যায়। বড়ই অদ্ভুত মানুষ সে।বর্ষা কাল যেদিন শুরু হয় ঠিক তার তিন দিন পরে শিল্পীকে এক পাত্র পক্ষ দেখতে আসে। পাত্রের যোগ্যতা কিছু কম নয় বটে। কিন্তু সমস্যা একটাই তার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। সেই বউয়ের বাচ্চা হয় না। তাই তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মধ্যবয়স্কের শেষ সীমায় এসে তার নিজের একজন সঙ্গী আর উত্তরসূরি রেখে যাওয়ার চিন্তা তীব্র ভাবে তাড়া করতে থাকে। সেই তাড়াহুড়োর ব্যাতিবাস্ততায়ই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম শিল্পীদের সেই অসম্পূর্ণ গলিতে।শিল্পীর বাবা মায়ের আত্মিয়তার কোনই কমতি ছিল না। অন্য কিছু দিয়ে না হোক অন্তত আপ্যায়ন য় ে যেন তাদের মুগ্ধ করা যায়।ছেলের বড় চাচি আর ছেলে যেদিন আসে সেইদিন প্রায় ৩২ পদের আইটেম ছিল। এতটা আপ্যায়ন মনে হয় তারা এর আগে কাউকেই করে নি, এমনকি বড় মেয়ের সময়েও না। শিল্পীকে পরের বাড়ি পাঠানো যেহেতু নেহায়েত সহজ কাজ না তাইই এই আপ্যায়নের ছদ্মবেশ।-মেয়ের পড়াশুনা কতটুকু?-আই এ পাস। পড়াশুনায় ও অনেক ভাল। কিন্তু আই এ পাসের পরে আর পড়াশুনা করাই নি। মেয়ে মানুষ এত পড়াশুনা করবে, তারপরে কি? — কথাটা বলেই শাহানা বেগম বুঝে ফেললেন কথাটা বেফাঁসে হয়ে গেছে। শিক্ষিত ফ্যামিলির কাছে পড়াশুনা করিয়ে কি লাভ এই ধরনের প্রশ্ন রাখা চরমতম বোকামি। তবে এতে শাহানা বেগমেরও দোষ ছিল না, কারন তার এই নিয়ে পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই, এর আগে শিল্পীকে দেখতে কোন ছেলেপক্ষ আসে নি। আর বড় মেয়ের বিবাহের সময়ও তার এত জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দেবার প্রয়োজন হয় নি।-মেয়ে আর কি কি করতে পারে ? এই যেমন শখ বলতে।– সেলাই করতে পারে। আমার মেয়ের রান্নাও খুব সুন্দর আপা। আর সে খুব ভাল কবি লিখতে পারে।নার্সারির গন্ডিতেও পা না মাড়ানো শাহানা বেগমের কবিতার তা টা স্লিপ কেটে কবি হয়ে যায়।কিন্তু এত অসম্পূর্ণতার পরেও কবিতা হয়ত ছেলে পক্ষকে কিছুটা আকর্ষিত করতে পেরেছিল। বিশেষ করে রফিকুল ইসলামকে।ছেলে পক্ষ হাসি দিয়ে বিদায় হয়, সে ছিল এক রহস্যপূর্ণ হাসি। তার আড়ালে কি যেন একটা ছিল।সেই হাসির আবেশে বেশ কয়েকদিন ধরে শিল্পীর ফোনে কথা বলাটা বন্ধ হয়। ছেলে পক্ষ বলেছিল জানাবে। এ সময় অন্য কারও সাথে কথা বলা যায় না।বিশ্বাস করবেন না খালা, আমি যে কি খুশি হইছি– কি কস, এইডা কি আর বলতে। আমার মাইয়াটার একটা গতি হউক।-আল্লাহ যা করে ভালই করে , আমরাই খালি বুঝি না।-হহ রে, কিন্তু অয় গেলে আমি কেম্নে থাকমু। সারাদিন জ্বালাইত খালি।-শিল্পীর হয় না হয় না কইরাও কপালে ভাল একটা ছেলে জুটব ইনশাল্লাহ। বিয়া করা এটা কোন বিষয় না। কত শিক্ষিত ! আমনে এত টেনশন নিয়েন না।-হহ, ওইডাই, ভদ্র অনেক। ময় মুরুব্বিগরে সম্মান করতে জানে।-ব্যাবহার অনেক বড় ব্যাপার। আমরা সবাই শিল্পীর এই বিয়া নিয়া কত চিন্তা করছি। ছেলে পক্ষ শেষ পর্যন্ত কি কয়?– কয় মেয়ে ভাল, পছন্দ হইছি , জানাইবে সব। আরে রাজি যে দেইখাই বুঝা যায়, সব কি আর লগে লগে প্রকাশ করা যায়।-ওইটাই। দুই রাকাত নামাজ মানছি রে বাপ, সব যদি ঠিকমতন হয়। আল্লাই সব। আল্লাহ তুমি আমার মাইয়াটারে একটা গতি কর।লে পক্ষ যে কতটা রাজি ছিল তা এক সপ্তাহ পরেই বুঝা যায়। কবিতার জোরদারিটা খুব একটা টেকল না শেষ পর্যন্ত। কারন কেউ একজন ছেলে পক্ষকে বলেছিল, ক বিতার উদ্দেশ্য হয়ত অন্য কেউ। কিন্তু শাহানা বেগম শত চেষ্টা করেও কেউ একজনটার পরিচয় জানতে পারলেন না। কেন কেউ একজন চায় না শিল্পীর বিয়ে হোক? সে সংসার করুক, সুখি হোক, কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তার? কেন সে চাইবে না?শিল্পীর সংকটের এই জীবনেও শেষ পর্যন্ত আরও তিনটে প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু সেই অভিশপ্ত কারও উপস্থিতি বারেবারে শিল্পীর জীবনের সেই সুখটাকে কেঁড়ে নিচ্ছিল। কি রে মা, আমাগো জীবনটা আল্লায় এরকম বানাইছে ক্যান? বারে বারে ক্যান এরম হয়? (হু হু হু)-(নিশ্চুপ, প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে তার চরিত্রের চিত্রায়ন দেখে সে হতবাক, তার বলার মতন আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না)।-কার অভিশাপ লাগছে, কোন কুত্তার বাচ্চায় বারেবারে এরকম করে মাবুদ খোদায় জানে , আমি কিচ্ছু বুঝতাছি না, কিচ্ছু ভাল লাগতাছে না আমার।ই নিয়ে মোট চারটা প্রস্তাবই ফিরে চলে গেল। শিল্পীর জন্য এটা অনেক বড় একটা বিষয়। তবুও তার বিকারগ্রস্থতা খুব বেশি সময় টেকে না। এই ভয়ঙ্কর বিষয়গুলোতেও সে খুব একটা বিচলিত হয় না, যদিও কিছু সময়ের জন্য তাকে নিশ্চুপ পাওয়া যায়, কিন্তু কিছু পরেই ফিরে আসে কিশোরীর উৎফুল্লতা।ল্পীর এই চাঞ্চল্যতা কে যে মানুষটা সবচাইতে বেশি অপছন্দ করত সে শিল্পীর খালাতো ভাই, ফারুক। সেই ছো থেকেই সে শিল্পীকে দেখছে, কিন্তু শিল্পীর এরকম বেহাইয়াপনা আচরন তার কখনই ভাল লাগত না বিশেষ। শিল্পীর দুই বছরের বড় ছিল ফারুক, তবুও শিল্পী বড় ভাই হিসেবে ফারুককে সম্মান করত না খুব একটা। ফারুককে তুই তুই করে ডাকতো। শাহানা খালা কষ্ট পাবে বলে ফারুক কখনো কোন অব্জেকশনও তুলে নি, কিন্তু সে প্রচন্ডভাবে এই ব্যাপারটাকে অপছন্দ করত। আর শিল্পীকেও।কিরে তুই এইচ এস সি দিছস ! খবর কি ? রেজাল্ট তো দিল।খবর তো জানসই, আমার জিগাস ক্যান?জানি না আমি, কেউ বলে নাই তো। অবশ্য বলতে পারলে তো বলবে।-তুই আমার ঘরের থেকে বের হ – তোর ঘর ? ? এটা আমার খালার বাসা। তোর কথা মত যাইতে হবে না কি?-তোরে বের হইতে বলছি তুই বের হ। এই বাসায় আর আসবি না। লজ্জা থাকলে বের হ, যাবেশি ভাব কোন সময়ই ভাল না।তুই বের হফারুক শাহানা বেগমের বাসা থেকে আস্তে বের হয়ে যায়। সে আজকে অপমানিত হয়েছে ঠিক কিন্তু তা নিয়ে ফারুককে খুব একটা বিচলিত হতে দেখা যায় না। সে মনে মনে এক ধরনের আনন্দও পাচ্ছে। আনন্দের কারন শিল্পী ফেল করেছে। এরকম অহংকারী মেয়েদের ফেলই করা উচিত। যারা বড় কাউকে সম্মান করতে পারে না, মানুষকে কষ্ট দেয় তাদের সাথে এরকম হওয়াই উচিত। শিল্পী ফেল করাতে ফারুকের অন্য একটা খুশির কারন ছিল ফারুক নিজেও আই এ পাস। শিল্পী এই আই এ পাস টা করে ফেললে হয়ত তার দেমাগের ধাক্কায় আর বাচা যেত না। যাই হোক, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।ফারুক, তোর একটা বন্ধুরে দেখলাম যে, ওইটা কে রে?-রাহাত?-আমি তো আর নি না, ওই যে ওই দিন তোর সাথে ছিল যে, তোর অফিসে দেখছিলাম।-ও আচ্ছা, ওর নাম রাহাতই।-হুম্ম, পোলাটা কি করে রে?-কি করব? চাকরি করে।-কিসে?-সরকারি চাকরি। এলজিডির বড় অফিসারের সাথেই থাকে সবসময়। এলজিডির সব কাজের জন্য ওর হাত লাগে, কোটি কোটি টাকার কাজ ওর হাত দিয়া যায়।-অহ, পোলাটা দেখতে শুনতেও ভাল দেখলাম।-হুম, ভালই। বাপ মা’র এক ছেলে। ভাল খুব।-আচ্ছা ওর সাথে শিল্পীর , বুঝছসই তো বাবা। মাইয়াটা আমার……………-কিন্তু খালা……এই ধরনের ইনিকুয়ালিটির ব্যাপার স্যাপার ফারুককে বেশ বিরক্ত করত। যেখানে রাহাত বাবা – মায়ের এত বড় ছেলে, মোটামুটি একটা চাকরিও করে, সরকারি চাকরিতে পোস্ট যেমনই হোক, অবস্থা বেশ ভালই হয়, তাছাড়া রাহাতের কিছু ক্ষেত্রে সাইনও অনেক বড় ব্যাপার। এরকম একটা ছেলেকে শিল্পীর মত মেয়ের জন্য ভাবাটাও তো দুঃসাহস। যেখানে শিল্পীর চেহারা বাদ দিলেও আচার আচরণ সব কিছুই মূর্খের মত , পুরুষ মানুষ দেখলে ঢুলে পরে তার স্বভাব। অথচ এই দুঃসাহসের ব্যাপারটাই ইদানিং দেখাচ্ছেন শাহানা বেগম। কারন এখন দুঃসাহস ছাড়া তার গতি নাই আবার দুঃসাহসেও গতি নাই। ফারুক খালার মুখের সামনে বিশেষ কিছু বলতেও পারে নি।-কিরে ফারুক, রাহাতের কি অবস্থা? কিছু কইছিলি?-নাহ , আমি কি কমু? আমনে এগুলা কি বলেন? রাহাত কত কোয়ালিফাইড, এডুকেটেড একটা ছেলে। এটা হয় না কি!-আমার মাইয়ারে যারা দেখতে আসছে তারা কেউই কি কম ছিল না কি?-দুষ্ট গরু দিয়া ভরা গোয়াল আর কি। এগুলা কইয়া এখন কি লাভ খালা। আর আপনার মেয়ের স্বভাবও তো খুব একটা ভাল না। সে সারাদিন ফোনে এত কি করে? আপ্নেও তো ডাক দেন না, ঠিক কইরা ডাক দিলে আজকে এরকম হইত না।শাহানা বেগম আর কিছুই বললেন না, ফারুক বাকি যতটা সময় ছিল শাহানা বেগম চুপ করেই ছিলেন। তার বলার মতন কিছুই ছিল না। মেয়েটাকে যে খুব একটা মানুষ করতে পারে নি সে সেটাও বুঝতে পারছে ভালভাবেই।শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহে শিল্পীর ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল। বিষয়টা খুব একটা এগিয়েই ছিল। ডাক্তার বলেছিল তার পক্ষে বেশিদিন বাঁচা সম্ভব না। বেশি হলে তিন বছর। হাসপাতালের বিছানায় অনেক রোগীর মত তাকেও একটা বিরাট কক্ষে খাটের উপরে রাখা হয়েছে। প্রায়শই তার শরীর খারাপ করে। সপ্তাহে অন্তত একবার রক্ত পালটানোর দরকার হয়, আরও যাবতীয় কাজ ছিল।কোন এক শ্রাবণ মাসেই শিল্পীর মৃত্যু হয়েছিল, ব্রেন টিউমারের কারনে। গল্প লেখকদের শ্রাবণ মাসের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ আছে। সে কারনেই গল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো হয় শ্রাবণ মাসে। আকাশে তখন থাকে কালো মেঘ। হটাত সব কিছু অন্ধকার হয়ে ঘনিয়ে আসে। এরপরেই শুরু হয় মেঘের গর্জন। তারপর ঝুম বৃষ্টি। কালো মেঘের মতন জীবনের অংশগুলোও মলিন হয়ে যায়। কখনো কখনো ঝর হলে তো সব কিছুই লন্ডভন্ডও হয়ে যায়।তবে সেই শ্রাবনের মেঘ ঘনাবার আগে কতগুলো সুন্দর ঘটনাও ঘটেছিল। ফারুকের সাথে বিয়ে হয় শিল্পীর। ফারুক ছেলেটা আগে থেকেই ভালবাসত শিল্পীকে। সেই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়ত ছিল শিল্পীর বিয়ে ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে। ব্রেন টিউমারের পরে শিল্পী বেশিরভাগ সময়ই সেই লুকোচুরি খেলা ছেলেটাকে বারে বারে দেখতে পেত। হয়ত তার একাকীত্বের জন্য সেই মানুষটা বারে বারে সপ্নের মাঝে এসে ভিড় করত। প্রতিদিন মনে হয় সপ্নের মানুষটা আরও বেশি কাছে এসে পড়ছে। অনেকটা কাছে, আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে আসছে তার চেহারা।ফারুকের ব্যাবসার থেকে মন গিয়ে পরে থাকত শিল্পীর কাছে। যাকে সে দেখতে পারত না হটাত করে তার জন্যই খারাপ লাগতে শুরু করে। শত হোক, মেয়েটা আর কদ্দিনই বা বাঁচবে। তার উপরে জেদ ধরে থেকে কি লাভ। ফারুক ১ সপ্তাহের জন্য ব্যাবসা বাদ দিয়ে খালার বাড়ি চলে আসে। সবার ভাবনার তোয়াক্কা না করে সে শিল্পীর সাথে সাথে থাকত। শিল্পীর সাথে কত ধরনের অদ্ভুত সব গল্প করে বেড়াত। কোন এক শুক্রবারে হটাত সে শিল্পীকে নিয়ে বের হয় ঘুরবার জন্য। এরপরে তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। এই টাইপের রোগীরা বিশেষ করে সে যখন মেয়ে হয় তার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চায় না, কিন্তু সে না চাওয়াটা খুব একটা জোরালো হল না যখন সপ্নের সেই বোকা ছেলেটার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠা শুরু করে।ফারুক আর শিল্পীর একটা বাচ্চা হয়। তারা অনেক ভেবে তাদের ছেলের নাম রেখেছিল প্রকৃতি। নামটা মানুষের নাম হিসেবে চমৎকার রকম অদ্ভুত ছিল। প্রকৃতি সত্যই অদ্ভুত। সে সবসময় চায় এক ধরনের সেলফিশ জীনকে বাচিয়ে রাখতে। সে কখনো সেটাকে নষ্ট হতে দিতে চায় না। হয়ত তাদের বহন করা আর কপি করাই আমাদের চূড়ান্ত আর চরমতম উদ্দেশ্য। আর এ কারনেই গল্পের মৃত্যুপথযাত্রি মেয়েটা হটাত করে তার সপ্ন পুরুষ হিসেবে দেখতে পায় সবচাইতে অপছন্দ করা কাউকে। আর ছেলেটাও হটাত করে অসহায়ভাবে পাগল হয়ে যায় সেই ভ্যাপসা রঙের মেয়েটার প্রতি, যে একসময় পাড়ার ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নানান রকম ছ্যাস্রামি করে বেড়াত।

-

বসন্ত এখনো সাজঘরে আমি তাই নক্ষত্রের উত্তাপ নেই শীতার্ত শরীরে। হেমন্ত বালক, তুমি নাকি অদ্ভুত বৃষ্টি নামাও.. অসময়ে ভিজিয়ে দাও চন্দ্রমল্লিকার পালক! তবু তোমার অস্তিত্ব ভূলে যায় ফসলের রাত খুব ধীরে স্পর্শ করে শীতের নগ্ন হাত.. আমলকির ডাল ঘিরে ভীড় করে কুয়াশার দল; তৃষ্ণার্ত হৃদয় পান করে মুঠো মুঠো জোছনার জল। চারপাশে ছায়ারঙা শীত আর রূপালী ঘাস.. তারপর চন্দ্রবিলাস! এক ষ্টেশনের চায়ের স্টলটাতে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কলিমুদ্দীন। দোকানি সুরুজ আলীর সাথে খোশগল্প করতে করতে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খাচ্ছিলো সে। আহ্‌, ব্যাটা জব্বর চা বানায়। মন খালি আরো খাই আরো খাই করে। কাঁচের চ্যাপ্টা বয়ামের ভেতরে সাজানো বিস্কুটগুলোকে বড়ই লোভনীয় দেখাচ্ছিলো। আলগোছেই দু’টা বিস্কুট হাপিস করার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো। সুরুজ আলীর সাথে কথোপকথনটাও চালু রেখেছে। ভাবখানা এমন যেন মনের ভুলেই হাতটা ঐদিকে চলে গিয়েছে, অন্য কিছু নয়। সুরুজ আলী খুব যত্নের সাথে হাতটা টেনে সরিয়ে দেয়। ‘কলিম ভাই, আইজগা চা খাইয়্যাই খুশি থাহো। তুমার আগের দেনাই কইলাম পঞ্চাশ ট্যাহা হইছে।’ মনে মনে কষে একটা গালি দেয় কলিমুদ্দীন। ব্যাটা শকুনের চোখ নিয়ে দোকানদারি করে। ‘আরে সুরুজ ভাই, দুইখান বিস্কুট খাইলে ফকির হইবা নি? আচ্ছা থাউক। দিয়া দিমুনি তুমার ট্যাহা...’ কথা বলতে বলতেই তার চোখ চলে যায় ষ্টেশনের শেষ মাথায় পলায়নোদ্যোত এক নারী মূর্তির দিকে। শিউলী না? এই সময় এমন ভাবে কোথায় থেকে আসছে? নাকি যাচ্ছে? ভাবসাবে তো মনে হচ্ছে কলিমুদ্দীনকে দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি পালাচ্ছে। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখেই সোজা সেই দিকে হাঁটা দেয় কলিমুদ্দীন। সুরুজ আলী পেছন থেকে ডাকতে থাকে, ‘চললা কই? চায়ের দাম দিবা না? তুমার ট্রেন তো আইয়া পড়বো এহন।’ ‘এহুনি আইতাছি। আইয়া ট্যাহা দিতাছি।’ হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয় কলিমুদ্দীন। ‘হুঃ! আর দিছো!’ শ্লেষাত্মক উক্তিটি ছুড়ে দিয়ে কাজে মন দেয় সুরুজ আলী। ব্যাটা অকর্মা কোথাকার! সাত সকালে এসে দুনিয়ার আজাইরা প্যাচাল জুড়ে দিয়েছে। চা টাও খেয়ে গেলো মুফতে। কাজের সময়ে এইসব ‘ডিস্টাব’ একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না সে। এদিকে শিউলীকে ধরার জন্য পড়িমড়ি করে ছুটেও লাভ হলো না কলিমুদ্দীনের। শিউলী একেবারে হাওয়া। ঠিক আছে, সমস্যা নাই। দুপুরে বাড়িতে ফিরে এর হিসাব নেওয়া হবে। ষ্টেশনে ফিরে আসলো সে। শুনশান নীরবতা ভাঙতে শুরু করেছে। হকার থেকে শুরু করে যাত্রী, কুলি, এমনকি ষ্টেশনের দোকানগুলো পর্যন্ত আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। একটা চটজলদি প্রাণচাঞ্চল্য যেন পেয়ে বসেছে সবাইকে। প্রতিবার ট্রেন আসার আগের মুহুর্তের এই হই-হুল্লোড় খুব ভালো লাগে কলিমুদ্দীনের। জীবন যে থেমে যায়নি এই অনুভূতিটা সে টের পায় এই সময়। আজ প্রায় কুড়ি বছর যাবত সে এই ষ্টেশনে কুলিগিরি করে আসছে। এক্কেবারে বাচ্চা বয়সে অল্প কিছুদিন ট্রেনে হকারের কাজ করেছে। সেই কাজটা বড় ভালো লাগতো তার। অন্যরকম একটা উদ্দীপনা ছিল। কাঠি লজেন্স আর চানাচুর বিক্রি করতো সে। ষ্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে যাত্রীদের ভীড় ঠেলে উঠে যেতো ট্রেনে। তার সহকর্মী অন্য হকারেরা পেরে উঠতো না তার সঙ্গে। ফুড়ুৎ করে সবার আগেই তার ট্রেনে উঠে পড়া চাই। বিক্রিও ছিলো ভালো। কাঠি লজেন্স দেখে বাবা-মা’র কাছে বায়না ধরতো না এমন কোন ছোট বাচ্চা ছিলো না। আর তার চানাচুরও ভালো বিকোতো। কিন্তু তার বাপ তাকে এই কাজ বেশিদিন করতে দিলো না। ছোটবেলা থেকেই সে ছিলো তাগড়া ধরনের। হাতে পায়ে জোরও ছিলো প্রচুর। হকারের কাজে আর কয়টাকা মুনাফা থাকে? তার বাপ তাকে কুলিগিরিতে লাগিয়ে দিলো। নিজেও সে এই কাজ করতো । বাচ্চা কুলিদের উপর মানুষের একটা সমবেদনা থাকে। অপেক্ষাকৃত কম বোঝা তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়। কিন্তু পয়সার বেলাতে আবার দু’পয়সা বেশিই দেওয়া হয়। কাজেই শূন্য পুঁজি, ডাবল মুনাফা। কিন্তু কলিমুদ্দীনের ভালো লাগতো না এই কাজ করতে। বাচ্চা কুলিদের ওপর সব যাত্রীই যে সমবেদনা দেখাতো, এমনটা মোটেও ঠিক না। কেউ কেউ বেশ দু’পয়সা ঠকিয়েও দিতো। বাচ্চা বলে প্রতিবাদের কোনো সুযোগও তো ছিলো না। এই কাজ বেশি করতো বয়ষ্ক মানুষেরা। আপাতদৃষ্টিতে যাদের প্রাণে দয়া মায়া বেশি আছে বলে মনে হয়। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরাই বরং ঠিকঠাক টাকা দিয়ে দিতো। একবার মধ্যবয়ষ্ক একজন মানুষ তাকে ভাড়া দেবার নাম করে একেবারে বাসা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো। খালি বাসায় দরজা বন্ধ করে...। তারপর সেই লোক কলিমুদ্দীনকে ভয় দেখিয়েছিলো এই বলে যে, কাউকে বললে পুলিশ উল্টো তাকেই ধরে নিয়ে যাবে। আর পুলিশ ষ্টেশনে তার উপর কী কী হতে পারে তার একটা বর্ণণাও দিয়েছিলো সেই লোক। ভয়ে কাউকে বলেনি কলিমুদ্দীন। দু’দিন কাজেও যেতে পারেনি। বাবার কাছে শরীর খারাপের অযুহাত দেখিয়েছে। এরপর থেকে সেই বাচ্চা কলিমুদ্দীনও বুঝে গেছে, দুনিয়াটা সাপ খোপে ভরা। ঠিকমত পা ফেলে চলতে না পারলে নিজের প্রাণটাই বেঘোরে চলে যাবে। কাজ করার ব্যাপারেও একটা ঢিলেমি এসে গেছে এর পরে থেকে। একটুও মন চাইতো না পরিশ্রম করতে। কীভাবে বসে বসে টাকা পয়সা কামানো যায়, সেই বয়সেই তার উপায় রপ্ত করতে শুরু করে সে। কেউ তাকে ঠকিয়ে দু’পয়সা নিয়ে যাবে, এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। প্রয়োজনে আরেকজন কে ভেঙে খাবে, কিন্তু অহেতুক খাটা-খাটনি করে মরার ইচ্ছা নাই তার। দুই শিউলী আজ জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছে। আরেকটু হলেই পড়েছিলো বাঘের মুখে। উত্তর পাড়ার টিপু শাহের বউ আজ অনেকদিন যাবত তাকে একটা কাজের কথা বলছিলো। সকাল সকাল তার বাড়িতে গিয়ে উঠোনটা লেপে দেওয়া, গোয়ালের গরু বাছুরগুলোর খাওয়ার জোগাড়যন্ত্র করে দেওয়া আর আসার আগে উঠোনে ধান-কলাই শুকাতে দিয়ে আসা। বিকেলে এক ফাঁকে গিয়ে সেই ধান-কলাই আবার তুলে রেখে আসা। এইতো এতটুকুন কাজ। আর এটুকু কাজের জন্যই গৃহস্থ তাকে নগদ পাঁচশো টাকা করে মাসে মাসে দিবে। অতি লোভনীয় কাজ। শিউলীর বড় ইচ্ছে কাজটা করার। কিন্তু তার ‘লাটসাহেব’ স্বামীর জন্য কোন কাজের নামই সে মুখে আনতে পারে না। শুনলেই একেবারে খেকিয়ে উঠে। ‘খুব কাম করনের হাউশ লাগছে মনেত, তাই না? মাইনষের বাড়িত কাম করবার যাইয়া ইজ্জত নিয়া আর বাঁচন লাগবো না। দুইডা কম খাও ক্ষতি নাই, ইজ্জত ডুবানের কাম নাই।’ হাঃ ইজ্জত! একা একা অনেক দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে শিউলী। ইজ্জতের সংজ্ঞাটা যে কী তা সে বুঝতে পারে নাই। স্বামীর কুলিগিরি’র টাকায় সংসার চলে না। ঠিকমত কুলির কাজ করলে সংসার না চলার কোনোই কারণ নাই। কিন্তু তার স্বামী পরিশ্রম করার চেয়ে শুয়ে বসে আরাম করতেই ভালোবাসে বেশি। আর জানে বড় বড় গপ্পো ছাড়তে। তার দাদা-পরদাদারা কেউ এসব বেগার খাটতো না। তাদের ছিল বিঘা বিঘা জমি। ক্ষেত ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। সেই ক্ষেতের ধান আর পুকুরের মাছ তারা নিজেরা খেয়ে কখনোই শেষ করতে পারতো না। যুদ্ধের সময় তাদের সেই বিপুল সম্পদ চলে গেছে অন্য মানুষের দখলে। এরপর থেকেই এই গরীবি দশা। হু, বিপুল সম্পদ না ঘোড়ার ডিম! বিয়ের পর প্রথম প্রথম শিউলী স্বামীর চিকনাচাকনা সব কথাই বিশ্বাস করতো। ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে, সব কথাই ভুয়া। কোন সম্পত্তি ছিল না তার শ্বশুরকূলে। এরা সাত পুরুষই ষ্টেশনে কুলিগিরি করে আসছে। রেলওয়ে জংশনের কাছে বাড়ি হওয়ায় অন্তত খাওয়া পরার একটা বন্দোবস্ত জুটেছে। না হলে যে কর্মঠ স্বামী তার! হালচাষ তো তাকে দিয়ে জীবনেও হতো না। কিন্তু এতদিন তাও যা হোক কিছু একটা করে দিন চলে যেতো। গতবছর ছেলেটা জন্মাবার পরে থেকে খরচ বেড়ে গেছে। ছেলের দুধ কিনতে হয়। ঠিকমত বুকের দুধ পায় না, দু’মাসের পর থেকেই বাচ্চাকে তোলা খাওয়াতে হয়। তাই খরচে আর কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। এখানে ওখানে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। শিউলী জানে, তার স্বামী কোনদিনই এসব দেনা মিটাতে পারবে না। এখনো লোকজন ধার দিতে অপারগতা জানাচ্ছে না, কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সেই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হবে না। এই তো, গত মাসে ট্রাক ড্রাইভার কুতুব মিয়া এসেছিলো ধারের টাকা ফেরত চাইতে। কলিমুদ্দীন বাড়িতে ছিল না বলে রক্ষা। থাকলে মনে হয় ভালোই একটা ঝামেলা বাঁধতো। কুতুব মিয়া আবার আসবে বলে সেদিনের মতো বিদায় নিয়েছে। যাওয়ার সময় চোখের আশ মিটিয়ে একটা নির্লজ্জ দৃষ্টি দিয়ে গেছে শিউলীর দিকে। শিউলীর ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে সেই চোখের চাউনি। এই লোক তো মনে হয় না সহজে পিছু ছাড়বে। তাছাড়া তার স্বামী আর মানুষ পেলো না? একজন ড্রাইভারের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হবে! সেদিনের কথা শিউলী স্বামীকে বলতে ভোলে নাই। সেই চোখের চাউনী পর্যন্ত। কিন্তু কলিমুদ্দীন নির্বিকার। এসব নাকি শিউলীর মনের ভুল। একটা বড় কাজ পেলেই সব দেনা চুকিয়ে দেবে, এমন আশ্বাস বাণীতে ভরসা পায়নি শিউলী। চব্বিশ ঘণ্টা ভয়ে থেকেছে কখন না জানি আবার কুতুব মিয়া চলে আসে! বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নাই। গত পরশুদিনই আবার হানা দিয়েছে সে। এবার একেবারে ঝেড়ে কেশেছে কুতুব মিয়া। ‘জামাইরে কও হয় ট্যাহা দিক, নয়তো বাড়িত বন্ধক দেওনের কিছু থাগলে হেইডা দিক। হেহ্‌ হে...।’ সেদিনের পর থেকে আর শান্তিতে নাই শিউলী। তার স্বামীর উপর ভরসা করে কাজ নাই। যা করার তাকেই করতে হবে। তাই সে আজ গিয়েছিল টিপু শাহের বাড়ি। সকাল সকাল কাজ করে চলে আসবে। সেই সময়ে তো কলিমুদ্দীন বাসায় থাকে না। তার স্বামী জানতে না পারলেই হলো। বাচ্চাটাকে সাথে নিয়েই যাবে। ছেলেটা বড় শান্ত হয়েছে তার। কান্নাকাটি একেবারেই করে না। যেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানেই বসে থাকে। টিপু শাহের বউ তাকে কাজে রেখেছে। দুইশো টাকা অগ্রিমও দিয়েছে। সবকিছুই ঠিক ছিল। ফেরার পথে ষ্টেশনের ভেতর দিয়ে শর্টকাট মারতে গিয়েই ভেজালটা বেঁধেছে। কেন যে এত বড় ভুলটা করতে গেলো! তবে মনে হয় কলিমুদ্দীন তাকে দেখতে পায়নি। এই যাত্রায় বেঁচে গেছে সে। কাজটা করবে শিউলী। একটু একটু করে টাকা বাঁচিয়ে মিটিয়ে দেবে কুতুব মিয়ার সব পাওনা। ঘরের বাইরে গিয়ে ইজ্জত হারানোর আশংকা করছে তার স্বামী। কিন্তু ঘরে বসে থেকে ইজ্জত বাঁচারও তো কোন সম্ভাবনা দেখছে না শিউলী। ফুটবল খেলাটি বাঙালির নিজস্ব খেলার তালিকায় নেই। তবুও বাংলা অঞ্চলে ফুটবলকে নিছক ছেলেখেলা হিসেবে দেখা মুশকিল। কারণ ধীরে ধীরে বিদেশি এই খেলাটি মিশে গেছে আমাদের জীবনযাপন, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে। তাই ফুটবল নিয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাস শুরু থেকেই। বাঙালি লেখকদের লেখাজোকায়ও নানাভাবে এসেছে ফুটবলের প্রসঙ্গ। প্রমথ চৌধুরী ১৯১৫ সালে রচিত তাঁর ‘সাহিত্যে খেলা’ নামের এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যবিহীন।’ ওই প্রবন্ধে তিনি ‘উদ্দেশ্যবিহীন’ বলতে আনন্দদায়ক বোঝাতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, খেলা উদ্দেশ্যবিহীন এবং আনন্দদায়ক বলেই কলকাতার টাউন হলের দেশহিতকর বক্তৃতার চেয়ে ‘গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে’ মানুষ বেশি যায়। খেলা সম্পর্কে, বিশেষত ফুটবল খেলা সম্পর্কে, প্রমথ চৌধুরীর এই বক্তব্য খুবই সরল এবং বাছবিচারহীন বলেই মনে হয়। বাংলা অঞ্চলে ফুটবল খেলাকে ছেলেখেলা হিসেবে দেখা খুব মুশকিল। বাংলায় ফুটবলের সাংস্কৃতিক-রাজনীতি আছে, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার আছে, আছে শ্রেণিচরিত্র। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঙালির খেলাধুলার-সংস্কৃতির এন্তার বর্ণনা আছে। প্রাচীন সাহিত্য ঘেঁটেঘুঁটে দেখা যায়, আদিতে শিকার বা মৃগয়া বাঙালির খেলার একটা অংশ ছিল। নিম্নবর্গের বাঙালিদের কাছে শিকার ছিল জীবিকা ও ক্রীড়া দুই-ই। উচ্চবর্গের কাছে এটি ছিল শুধুই খেলা। বাংলা সাহিত্যের ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্য-এর ‘কালকেতুর বাল্যক্রীড়া’ উপশিরোনামে দেখা যায় সেখানে খেলা ও শিকার সমার্থক। কবির ভাষায়, ‘শিশুগণ সঙ্গে ফিরে, তাড়িয়া শশারু ধরে/দূরে পশু পালাইতে নারে।/বিহঙ্গ বাট্যুলে বধে/লতাতে জড়ায়ে বান্ধে/কান্ধে ভার বীর আস্যে ঘরে।’ শুধু মধ্যযুগের নায়ক কালকেতু কেন, বাংলাদেশে বর্তমানে জীবিত পুরোনো প্রজন্মের যাঁরা আছেন, তাঁরাও নিশ্চয় জানেন, শিকার তাঁদের কাছে একটা আনন্দময় খেলাই ছিল বটে। বাঙালির খেলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস বইয়ে বলেছেন, ‘কুস্তী বা মল্লযুদ্ধ এবং নানাপ্রকারের দুঃসাধ্য শারীর-ক্রিয়া ছিল নিম্ন কোটির লোকদের অন্যতম বিহার (পড়ুন: খেলা)। পবনদূতে নারীদের জলক্রীড়া এবং উদ্যান রচনার উল্লেখ আছে; এই দুটিই বোধ হয় ছিল তাঁহাদের প্রধান শারীর-ক্রিয়া। দ্যূত বা পাশাখেলা এবং দাবা খেলার প্রচলন ছিল খুব বেশি। পাশাখেলাটা তো বিবাহোৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ বলিয়াই বিবেচিত হইত।’ (পৃ. ৪৪৯)। দাবা খেলার প্রসঙ্গ তো বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ-এ হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যযুগের সাহিত্যে লাঠিখেলা, ঘোড়দৌড়ের উল্লেখও বেশ দেখা যায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ফুটবল খেলাটা বাঙালির নিজস্ব খেলার তালিকায় নেই। খাঁটি বাংলায় বলতে গেলে বাংলায় ফুটবলের ইতিহাস শুক্কুরে শুক্কুরে সাত দিনের ইতিহাস। বাংলামুলুকে ফুটবল খেলাটা ঢুকেছে মূলত ইংরেজ উপনিবেশের হাত ধরে। ইংরেজ রাজ-কর্মচারীরা তাঁদের বিকেলের সময় কাটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে এই খেলাটা খেলত। এক এলাকার রাজ-কর্মচারীরা অন্য এলাকার রাজ-কর্মচারীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে প্রতিযোগিতারও আয়োজন করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে (১৮৫৪-এর পর থেকে) কলকাতা ও ভারতের অপরাপর অঞ্চলে এই খেলার খেলোয়াড় এবং দর্শক দুটোই ছিল ইংরেজ। ক্রমে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলার ইংরেজ-সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণি। আরও পরে দর্শক হিসেবে ‘সাধারণ মানুষের’ সমাগম ঘটতে থাকে। তবে এই ‘সাধারণ’ বলতে নিশ্চয় খেটে খাওয়া মানুষ না। এই ‘সাধারণের’ও একটা শ্রেণি-পরিচয় ছিল। তারা অবশ্যই সেই শ্রেণি, যারা এ দেশে ইংরেজ শাসনের স্থানীয় খুঁটি হিসেবে কাজ করত অথবা পড়ালেখা শিখে যারা কালো চামড়ার ইংরেজ হয়ে উঠতে চাইত। হেয়ার স্কুলের ছাত্র ও ‘অভিজাত’ বংশের ছেলে নগেন্দ্রপ্রসাদের হাত ধরে ফুটবল বাঙালির মধ্যে খেলা হিসেবে প্রবেশ করে। হেয়ার স্কুলের এই ছাত্রটি নিশ্চয় ইংরেজ অনুকরণের মনোস্তত্ত্ব থেকে এ খেলাটা শিখতে চেয়েছিলেন। ১৮৮৪ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদ যখন তাঁর সমমনা বন্ধুদের নিয়ে ডালহৌসি ফুটবল ক্লাব গঠন করছেন, তার আগের দশকে বাঙালির ইংরেজ অনুকরণ নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) প্রমুখ রচনা করেছেন অসাধারণ অসাধারণ সব প্রহসন। যা হোক, নগেন্দ্রের ডালহৌসি ফুটবল ক্লাব বেশি দিন টেকেনি। অগত্যা ১৮৮৫-তে ‘শোভাবাজার ক্লাব’ নামে তিনি আরেকটি ক্লাব গঠন করেন। ক্লাবের নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইংরেজের ফুটবল কীভাবে স্থানীয় হয়ে উঠছে। ১৮৮৯-তে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আরেকটি স্থানীয় ক্লাব—মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব। শোভাবাজার ক্লাব ১৮৯২ সালে যখন ট্রেসড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ইংরেজ ক্লাব ‘ইস্ট সারে রেজিমেন্ট’কে হারিয়ে দেয়, তখন বাংলায় ফুটবলের নতুন মানে দাঁড়ায়। আরও নতুন মানে দাঁড়াল ১৯১১-এ, মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন শিল্ড কাপ জেতার পর। ফুটবল সে সময় আর নিছক ইংরেজ-অনুকরণের বিষয় হিসেবে না থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়। ১৯১১ সালের ২৯ জুলাইয়ের সেই ইংরেজ-বাঙালি খেলায় মানুষের ঢল নেমেছিল। এমনকি ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে হাজার হাজার মানুষ সেদিন গিয়েছিল কলকাতার সেই খেলা দেখতে। কেন গিয়েছিল? ওই দলের ১১ জনের ১০ জনই পূর্ব বাংলার খেলোয়াড় ছিল সে জন্য? শুধু তাই নয় বোধ হয়। তারও চেয়ে বেশি কিছু। এর অন্যতম কারণ বোধকরি স্বামী বিবেকানন্দের ফুটবল-সম্পর্কিত সেই বাণী, ‘পদাঘাতের বিপরীতে পদাঘাত কেবলমাত্র ফুটবলেই সম্ভব।’ ফুটবল সেদিন হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকাশের দারুণ এক অস্ত্র। ফুটবল খেলা সেদিন আর প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় শুধু ‘উদ্দেশ্যবিহীন’ আনন্দদায়ক খেলা রইল না, হয়ে উঠল ‘প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার’। ফুটবল যে সেই কালে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আবেগের বিষয় হয়ে উঠেছিল, এ কথা বিখ্যাত ঐতিহাসিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর ব্লাক হোল অব এম্পেয়ার (২০১২) বইয়ে সবিস্তারে দেখিয়েছেন। কথিত আছে ১৯১১-এ বঙ্গভঙ্গ যে রদ হয়েছিল, ফুটবলকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেই জাগরণ এর অন্যতম কারণ। হয়তো এ কথা মিথ, মানে মিথ্যার মতো, কিন্তু সত্যের চেয়েও বেশি সত্য। ১৯১১ সালের মোহনবাগানের জয় বাঙালির মধ্যে এত গভীর দাগ কেটেছিল যে এই জয় নিয়ে ১৩১৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যার মানসী পত্রিকায় করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এক কবিতা লেখেন। কবিতার একাংশ এরূপ,Ñ‘জেগেছে আজ দেশের ছেলে পথে লোকের ভীড়,/অন্তঃপুরে ফুটল হাসি বঙ্গরূপসীর।/গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,/আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।/আজকের এই বিজয়বাণী ভুলবে নাকো দেশ,/সাবাশ সাবাশ মোহনবাগান খেলেছ ভাই বেশ।’ এই কবিতাটি পরে গান আকারে গীত হয় এবং কলকাতায় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯১১-এ বাঙালির হাতে ইংরেজ যখন ফুটবলে পরাজিত হলো, কাজী নজরুল ইসলামের বয়স সে সময় ১২ বছর। তখন দারিদ্র্যের সঙ্গে অভাবনীয় সংগ্রামে রত এক কিশোর তিনি। এই কিশোর আর মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে ইংরেজের ভিত-কাঁপানো সব কাব্য-কবিতায় ভরিয়ে তুললেন বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার। ১৯২০-এর দশকের প্রায় পুরোটা সময় নজরুলের কেটেছে মূলত প্রবল ইংরেজ বিরোধিতায়। তাঁর বইয়ের পর বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জেল খেটেছেন ইংরেজবিরোধী কবিতা লেখার দায়ে। এই কবি যদি দেখেন আধিপত্যবাদী শোষক ইংরেজকে কোনো ফুটবল খেলায় বাঙালি ছেলেরা পরাজিত করেছেন, তখন তিনি কেমন উন্মাদনা বোধ করতে পারেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। সালটি ১৯২৮। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়। সেবার মোহনবাগান ক্লাব এক ইংরেজ ফুটবল ক্লাবকে (ডিসিএলআই?) পরাজিত করে। ইংরেজ উৎখাতই যাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়, তিনি বাঙালির এই জয়ে সৃষ্টিছাড়া আনন্দে ভাসবেন—এ আর নতুন কী! ফলে সেদিনের সেই জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন। উদ্দেশ্য ইংরেজ-বধ উদ্‌যাপন! কল্লোল যুগ বইয়ে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘সুতরাং খেলার মাঠ থেকে সোজা শেয়ালদা এসে ঢাকার ট্রেন ধরল তিনজন। দীনেশরঞ্জন, নজরুল আর নৃপেন।’ (পৃ. ১২৬)। কারণ হিসেবে অচিন্ত্য বলেছেন, ইংরেজের বিরুদ্ধে সেই খেলায় ঢাকার ছেলে মনা দত্ত বা রবি বোস বেশ কয়েকটা গোল দিয়েছিলেন। অচিন্ত্যের ভাষায়, ‘ঢাকার লোক যখন এমন একটা অসাধ্য সাধন করল তখন মাঠ থেকে সিধে ঢাকায় চলে না যাওয়ার কোনো মানে হয় না। যে দেশে এমন একজন খেলোয়াড় পাওয়া যায় সে দেশটা কেমন দেখে আসা দরকার।’ (পৃ. ১২৬)। আদতে সৃষ্টিছাড়া এক আনন্দে আত্মহারা হয়েই তিনি ঢাকা এসেছিলেন। গোলাম মুরশিদ তাঁর বিদ্রোহী রণক্লান্ত (২০১৮) বইয়ে নজরুলের সেবারের হঠাৎ ট্রেনে চেপে ঢাকা আসা সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিজের পরিবারকে বলে যাওয়ার বালাই নেই, সওগাতকে জানানোর দরকার নেই, প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। দায়িত্বহীনতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার দৃষ্টান্ত বটে।’ (পৃ. ৩১৮)। কিন্তু সত্যিই কি এটা ‘দায়িত্বহীনতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা’! নাকি ইংরেজ-বধের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ! ইংরেজকে ফুটবলে পরাজিত করার মধ্যে কি নজরুল তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন মাতৃভূমির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেখে আত্মহারা হয়েছিলেন! ব্যক্তিটি যখন নজরুল তখন তাই হওয়াটাই তো স্বাভাবিক! ফুটবল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যেমন শাণিত করেছে তেমনি বিতর্কও কম তৈরি করেনি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফুটবল এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে সাহিত্যে খেলার প্রসঙ্গ মানেই ফুটবল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শ্রীকান্ত (১৯১৭) উপন্যাসে ফুটবল খেলার এক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ। সন্ধ্যা হয় হয়। মগ্ন হইয়া দেখিতেছি। আনন্দের সীমা নাই। হঠাৎÑ ওরে বাবাÑএ কি রে! চটাপট্ শব্দ এবং মারো শালাকে, ধরো শালাকে!...পাঁচ-সাতজন মুসলমান-ছোকরা তখন আমার চারিদিকে ব্যূহ রচনা করিয়াছেÑপালাইবার এতটুকু পথ নাই।’ (শ্রীকান্ত, প্রথমপর্ব, পৃ.Ñ২) শরতের এই ‘বাঙ্গালী’ এবং ‘মুসলমান’ দল বিভাজন উত্তরকালে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি শরৎচন্দ্র মুসলমানদের বাঙালি মনে করতেন না! নাকি শরৎচন্দ্র সমকালের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছিলেন মাত্র। এ এক ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়ই বটে! মিলন আর দ্বন্দ্ব যা-ই সৃষ্টি করুক না কেনো বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে ফুটবল খেলা বাংলা অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বর্তমানে ফুটবল গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে প্রবেশ করলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে অবিভক্ত বাংলায় ফুটবল ছিল মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকর্ষণীয় খেলা। ফুটবল যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির খেলা ছিল তা জসীমউদ্‌দীনের হাসু (১৯৩৮) কাব্যগ্রন্থের ‘ফুটবল খেলোয়াড়’ কবিতা দেখলেই বোঝা যায়। এই কবিতায় দেখা মেলে জসীমউদ্‌দীনের কাব্য-কবিতার মধ্যে সবচেয়ে ‘স্মার্ট’ নায়ককে—ইমদাদ হক। সোজন, রূপাই নামের বিপরীতে এই নাম ‘স্মার্ট’ আর নির্দিষ্ট শ্রেণি-চিহ্নিতই বটে। আবার এই যুবক থাকেও শহরের ‘মেসে’। কবির ভাষায়, ‘আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়।’ সমকালের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ফুটবল কী এক তীব্র উন্মাদনা ছড়িয়েছিল তার এক বিশ্বস্ত ছবি পাওয়া যায় এই কবিতায়। ইমদাদ হককে সকালবেলা গিঁটে গিঁটে মালিশ আর সেঁক দিতে দিতে মেসের চাকর ‘লবেজান’ হয়ে যায়। সবাই ভাবে ইমদাদ ‘ছমাসের তরে পঙ্গু যে হল হায়’। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় দেখা গেল ‘বাম পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা,/ভাঙা কয়খানা হাতে-পায়ে তার বজ্র করিছে খেলা।’ ফুটবল আনন্দদায়ক খেলা—এটা যেমন সত্যি, তেমনি এ-ও সত্যি যে ফুটবলের সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক-রাজনৈতিক পরিচয় আছে। আছে সাহিত্যের অন্দরমহলে হানা দেওয়ার মতো অসামান্য ক্ষমতা। আছে প্রবল সম্মোহনী শক্তি। আপাত নিরীহ এই খেলাটার মধ্যে আছে ইতিহাসের সরল-জটিল সব অলিগলি আর আলো-আঁধার। তিন গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে একটা কথাও বলে না কলিমুদ্দীন। আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। তারপর আয়েশ মতো একটা বিড়ি ধরিয়ে ডাক দেয় শিউলীকে। ‘আইজ কই গেছিলি?’ চমকে ওঠে শিউলী। ও, তাহলে নজর এড়ায় নাই। এইসব দিকে নজর ঠিকমতো আছে। জানে সে, মিথ্যা বলে লাভ নেই কোনো। তাই মাথা সোজা রেখেই বলে, ‘টিপু শাহের বাড়িত গেছিলাম। কামডা নিছি আমি।’ ‘এঃ! কামডা নিছি আমি! তুই নেওনের মালিক হইলি কুন্দিন থনে? আমি করবার দিমু ভাবছোস? ঐ টিপু শাহ্‌ লোক কেমুন জানোস কিছু?’ ‘হেইডা জাইন্যা আমার কী? আমি আমার কাম কইর্যান চইল্যা আইমু।’ ‘এঃ! কাম কইর্যাস চইল্যা আইমু! তোরে আইবার দিলে তো! আমের আঁঢির লাহান চুইষ্যা খাইবো, বুঝছোস?’ ‘আর, ঘরেত বইয়্যা থাহলে আপনের ডেরাইভার আমারে চুইষ্যা খাইবো।’ ‘খালি মুহে মুহে কতা। আমি করবার দিমু না। ব্যস, এইডা আমার শ্যাষ কথা। এর পরেও যুদি করার ইচ্ছা থাহে, তোরে আমি তালাক দিমু।’ এইটা শুনে আর কথা সরে না শিউলী’র মুখ থেকে। একেবারে বোবা হয়ে যায় সে। ওদের চেঁচামেচিতে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে বাচ্চাটা। শিউলী দৌঁড়ে গিয়ে বুকে নেয় তাকে। মায়ের বুকের ওমে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে। কলিমুদ্দীন দুমদাম দাম্ভিক পা ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সেদিন বিকেলেই একটা ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটে। চলমান ট্রেন থেকে যাত্রীর কাছ থেকে মাল-সামান নিতে গিয়ে অসাবধানে কলিমুদ্দীনের একটা পা চলে যায় ট্রেনের চাকায়। চোখের পলকেই পা টা একেবারে থেঁতলে যায় তার। ষ্টেশনের বিপুল কোলাহল আর শোরগোলের মাঝেই ভীষণরকম বেমানানভাবে অসার, নিঝুম হয়ে আসে কলিমুদ্দীনের জগতটা। চার ডান পা টা কেটে ফেলতে হয় কলিমুদ্দীনের। শুরু হয় তার অন্য জীবন। হাতে সামান্য যে ক’টাকা গচ্ছিত ছিল, চিকিৎসা বাবদ সেটাও চলে যায়। পুরোপুরি পথে বসে যায় পরিবারটি। এক কামরার ছোট্ট যে বাসায় তারা থাকতো তার যৎসামান্য ভাড়া মেটানোও আর সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। বাকী পড়ে যায় বেশ কয়েক মাসের ভাড়া। বাড়িওয়ালা প্রথম কিছুদিন এসে উহুঁ আহা করে যায়। আস্তে আস্তে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একসময় ভাড়া দেওয়ার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে। বাচ্চাটার দুধ কেনা হয় না। ঠিকমত ভাতই জুটে না এখন, আর দুধ! ভাতের ফেন, একটু সুজি....যখন যা পারে তাই খাওয়াতে শুরু করে বাচ্চাটাকে। একবছরের শিশুও বুঝি বুঝে যায় যে, এখন মর্জি করলে চলবে না। তাই যা পায়, সেটুকুই চেটেপুটে খেয়ে নেয়। এর মধ্যে গজবের মতো একদিন এসে উপস্থিত হয় ড্রাইভার কুতুব মিয়া। কলিমুদ্দীনকে পেয়ে খিস্তি খেউড়ের মাতম উঠায়। এতদিন ধরে ধার নিয়ে বসে আছে। তার টাকা মেরে খেলে সে কলিমুদ্দীনকে জানে মেরে ফেলবে এই হুমকিও দিয়ে যায়। ফেরার পথে উঠোনে একা পেয়ে শিউলীর কানে কানে বলে যায়, ‘ল্যাংড়া জামাই লইয়্যা আর কী ঘর করবা গো সুন্দরী? কুপ্রস্তাব দিতাছি না। ভাইব্যা দেহো। বিয়্যা করমু তুমারে। রাজি থাগলে কও। তুমার জামাইয়ের দেনাও মাফ কইর্যা দিমু তাইলে। এই লও আমার ঠিহানা। বাচ্চা নিয়্যা আইলেও রাজি আছি।’ শিউলী ছুটে ঘরে এসে জামাইয়ের অবশিষ্ট পা টা চেপে ধরে। ‘আপনার দুহাই লাগে। আমারে এইবার কাম করনের অনুমতি দ্যান। নাইলে আমরা কেও বাঁচবার পারুম না। আপনি আমার লাইগ্যা চিন্তা করবেন না। আমি বাঁইচ্যা থাকতে আমার ইজ্জত খুইতে দিমু না। আমারে আপনি কাম করবার দ্যান। আমার বাচ্চাডারে বাঁচাইবার দ্যান।’ কলিমুদ্দীন দার্শনিকের মতো বলে, ‘বউ, ইজ্জত হইলো বেবাকের আগে। এইডা বুঝোন লাগবো। মাইনষ্যের বাড়িত কাম করলে হেই ইজ্জতের কিছুই বাকি থাগবো না। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি উপায় ভাইব্যা থুইছি। কাল থিইক্যা ইস্টেশনে বসমু আমি। গ্যাদারে লগে দিও। মাইনষ্যে ছোডো বাচ্চা দেহলে ট্যাহা দিইয়্যা ভরাইয়্যা দেয়। তুমি বাড়িত বইস্যা ট্যাহা গুইন্যা শ্যাষ করবার পারবা না।’ শিউলী বিষাক্ত চোখে তাকায় কলিমুদ্দীনের দিকে। ভাগ্যিস, সেই দৃষ্টির ভাষা পড়বার মতো যোগ্যতা কলিমুদ্দীনের নেই। পরদিন সকাল বেলাতেই কলিমুদ্দীন একটা মাদু্র আর টাকা রাখবার একটা ডিব্বা নিয়ে ষ্টেশনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। চিকিৎসার সময় সদর হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব তাকে দয়া করে একজোড়া পুরনো স্ক্র্যাচ দিয়েছিলেন। সেটার সাহায্যেই সে বেশ একা একা চলতে পারে। যাওয়ার আগে শিউলীকে বলে যায়, ‘ও বউ, আমি যাইতাছি। তুমি এট্টু পরে গ্যাদারে লইয়্যা যাইয়ো।’ শিউলী তাকিয়ে তাকিয়ে তার স্বামীর চলে যাওয়া দেখে। পরাজিত, জীবন থেকে পলায়নকারী একজন মানুষ। অথচ, তার চালচলনে এখনো কেমন ইজ্জতের বড়াই! ঠিকই তো, ইজ্জতটা চলে গেলে আর কী থাকবে? শিউলী নিজেও তৈরি হয়ে নেয়। বিয়ের সময়ের টিনের ট্রাঙ্কটা বের করে ওর কাপড়গুলো গুছিয়ে নেয়। বাচ্চাটার কাপড়গুলোও ভরে নেয়। শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখে স্বামীর বাড়ির দিকে। ওর নিজের হাতে গোছানো সংসার, হাড়িকুড়ি, চুলার পাড়, দেয়াল ঘেঁষে ওরই হাতে লাগানো পুঁইয়ের চারা। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে। তিনরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে যায় শিউলী। রাস্তা ঘুরে গেছে তিন দিকে। তার বাপের বাড়ির পথ চলে গেছে ডানদিকে। আসা যাওয়া নাই কতদিন! কী জানি! রাস্তাটা আগের মতোই হাঁটার যোগ্য আছে, নাকি খানাখন্দে ভরে গেছে! বাঁয়ের সরু পথটা যে গন্তব্যে গেছে সেই ঠিকানা তার হাতে্র মুঠোয় ধরা। এই পথে কোনোদিন চলেনি সে। ঠিকঠাক পথের দিশা খুঁজে পাবে কিনা তা তার অজানা। সামনের সোজা পথটা অনেক চওড়া, সমতল...এতটুকুও বন্ধুর নয়। হাতছানি দিয়ে শিউলীকে যেন ডাকছে সে পথ। কিন্তু শিউলীর জানা নেই সেই পথের শেষে সে কোন গন্তব্যের দেখা পাবে। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাতে থাকে সে। পথচলতি দু’চারজন মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে। একেকজনের চোখে একেকরকম প্রশ্ন। সব প্রশ্নের ভাষা একেবারে অজানা নয় শিউলীর। বাচ্চাটার মুখের দিকে পূর্ণচোখে একবার তাকায় সে। একটা কোনো ইঙ্গিতের আশায়। বেশি সময় নেওয়া যাবে না। খুব তাড়াতাড়িই একটা পথ তাকে বেছে নিতে হবে। ভ্যাপসা আচমকা বৃষ্টিটা থেমে গেল। এরপরেই শুরু হল মেঘের গর্জন। কিছুক্ষন পর সব কিছু পরিস্কার। বৃষ্টির জন্য রাস্তার মাঝে পানির গড় উচ্চতা ছিল ১০ মিমি। কোথা থেকে একটা কাক এসে যেন পানির মাঝে কি খোঁজা শুরু করল। মেয়েরা আংটি হারালে যেরকম করে খুঁজে। কিন্তু কাকের তো আংটি নেই সে কি খুজবে পানির মাঝে ! এই বিষয়টা নিয়ে মেয়েটা খুব কৌতূহলী এবং বিরক্ত। কারন সে জানতে পারছে না কাকটা কি খুজছে। কাকের কান্ড কারখানার দর্শকই হচ্ছে আমার গল্পের নায়িকা। চোখের মাঝে যেন একটা বিল ঢুকে আছে। চাহনি দিয়েই সম্মোহনের এক অপূর্ব ক্ষমতা রাখে সে। খুব অল্প কিছু মানুষই তাদের জীবনে এরকম অদ্ভুত সুন্দর কারো দর্শন পায়। এমনই অপূর্ব রূপবতী ছিল আমার গল্পের নায়িকা। যারা বর্ণনা গুলো পরে আগ্রহ পাচ্ছেন তাদের জন্য দুঃখিত। কারন মেয়েটা এরকম বিশেষ সুন্দরী কিছুই ছিল না। ইটের দেয়াল পুরানো হয়ে গেলে তার উপরে যেমন একটা ভ্যাপসা রঙ পরে মেয়েটার রঙ ছিল সেরকমই। শ্যামলার চাইতে নিচে। চেহারায়ও বিশেষ সুন্দরের কোন ছাপ ছিল না। গল্প এদ্দুর পরে অনেকেই রেখে দেবেন, কারন কুৎসিত মেয়েদের নিয়ে গল্পগুলো কল্পনা করতে এক ধরনের অস্বস্তি লাগে। বিরক্তি হয়। সৌন্দর্য অনেক বড় একটা ব্যাপার। তাই গল্পের নায়িকাগুলো চমৎকার সুন্দরী হয়। লোকে আগ্রহ পাবে তবে। শিল্পির অনেকদিন ধরেই একটা ইচ্ছে ছিল; একটা সাদা শাড়ি কিনবে। কারন সেবারের পহেলা বৈশাখে সাদা শাড়ি লাল পারের একটা শাড়ি দেখেছিল একটা মেয়ের গায়ে। আগে সাদা শাড়ি দেখলেই বিধবা সাইন মনে হত, কিন্তু মেয়েটার গায়ে শাড়িটা দেখে তার এতটা ভাল লেগেছিল যে সে এই জিনিসটা নিয়ে বেশ কয়েকবার সপ্নও দেখেছে। প্রথম স্বপ্নটা ছিল শিল্পি সাদা শাড়ি পরে কাশফুলের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে । কে তার চেহারাটা বুঝে উঠা মুশকিল। এক ধরনের লুকোচুরি খেলা। কিন্তু ছেলেটা একটু বোকা টাইপের, সে শিল্পিকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর কিছু সময় পরে পরেই অস্থির হয়ে উঠছে। শিল্পির জীবনে এটাই প্রথম সপ্ন যেটা সে অনেক সময় ধরে মনের আশ মিটিয়ে দেখতে পেরেছিল।সাদা শাড়ির কথা শিল্পি মাকে অনেক বলেছিল। কিন্তু মা বিশেষ পাত্তা দেয় নি। শিল্পীর মা আসলে তাকে বুঝাতে চাচ্ছে না যে সাদা শাড়িতে শিল্পিকে মোটেই ভাল লাগবে না। কারন সাদা শাড়ির আড়ালে ভ্যাপসা কেউ। মোটেই মানাবে না। অনেক কৌশল করেও শিল্পীর মা তাকে সেটা বুঝাতে পারে নি। যদি তার অনেক টাকা থাকত তাহলে সে মেয়েটাকে অবশ্যই সাদা শাড়ি দিত। এমনকি না মানালেও। কিন্তু যাদের কাছে অনেক টাকা থাকে না তাদের কে বেছে বেছে কিনতে হয়। মানানো না মানানোর বিষয়গুলো নিয়ে অনেক ভাবতে হয়। অথচ ২৪ বছরের এই মেয়েটাকে সেই সহজ কথাটা বুঝানো যাচ্ছে না। বিয়ে করালে ঠিক সময়ে এখন এর একটা বাচ্চা থাকত।– মা, জান কালকে রাত্রেও সপ্নে দেখি আমি সাদা শাড়িতে, একটা নৌকার উপরে । চারিপাশে পানি আর পানি , চলন বিল।– তোর বয়স কত?– ২৪-২৫ ক্যান?-আমি এরকম সপ্ন দেখতাম ১৫ বছর বয়সে। তোর মাথায় কি কিছু নাইরে শিল্পি। এত বড় হইছস। কি অবস্থা সংসারটার। আর তার মইদ্ধে…-থাক হইছে, আর চিল্লাফাল্লা কইরো না, তোমার চিল্লাফাল্লায় কান ঝালাফালা হইয়া যায় ।শিল্পির মা কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। শাহানা বেগমের তিন মেয়ে। শিল্পি মেঝ। অথচ তার আচরণে মনে হয় সেইই যেন সবার ছোট। শিল্পীর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট বোনটা তার স্কুলের এক ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। সংসারে এখন শুধু শিল্পীই একা। শাহানা বেগমের এই বয়সে এসে কাউকে নিজের সাথে সাথে সবসময় রাখতে ইচ্ছে করে। শিল্পীর বিয়ে নিয়ে তাই তার বিশেষ কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু তারপরেও মাথা ব্যাথা আনতে হয়। কারন মেয়েটার বয়স হয়ে যাচ্ছে। এর যদি এখন বিয়ে দেয়া না যায় ……… । ‘ মেয়েটা আমার একটু রংচটা বলে………… মানুষ কে কি শুধু চেহারার সুন্দর দিয়েই বিবেচনা করা যায় ! ? ? মনের কি কোনই দাম নে ই !’ খুব সম্ভবত যাদের চেহারা সুন্দর না তারাই এমনটা ভাবে।এত অসৌন্দরযের মাঝেও, কেউ হয়ত সত্যিই শিল্পীর সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিল। যাকে সে প্রায়ই সপ্নে দেখত, কিন্তু কখনই মানুষটার সম্পূর্ণ মুখ দেখে উঠতে পারে নি। হয়ত তাকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ একজন যদি সৌন্দর্য খুঁজে নাইই পায় তবে প্রকৃতির উদ্দেশ্য সফল হবে কি করে। প্রকৃতি সবসময়ই একটা বন্ড পেয়ার তৈরি করে। আমাদের জীনের এলিলে এক্স আর ওয়াই এর শতকরা মান ৫০% করে। কিছু মারাত্মক রকম স্বার্থপর জীনকে ট্রান্সফারের জন্য প্রকৃতি আমাদের প্রোগ্রাম করে রাখছে, এখানে সে প্রত্যেকের জন্যই কোন না কোন একজনকে ঠিক করে রেখেছে। সেই ঠিক করা মানুষটাকে শিল্পী চিনে উঠেও চিনতে পারছে না।স্বভাবতই যৌবনে প্রেম ভালবাসা করতে না পারার কারনে শিল্পীর মনের প্রেমের অতৃপ্ত শুন্য স্থানটা আরও গভির হতে থাকে। এই কারনেই পাঁচ টাকার নোটের উপরে লিখা নিঃস্বার্থ প্রেমিকদের নাম্বারে তাকে প্রায়ই ফোন করতে দেখা যায়। এদের সাথে শিল্পীর কথাবার্তা খুব একটা এগোয় না। কারন এই নিঃস্বার্থ প্রেমিকরা ছেঁচোড়ের দলে। শিল্পী এখনো তাদের মত হতে পারে নি। কিন্তু চারিদিক তাকে ক্রমশই ছেঁচোড় করে তুলছে। এখন হয়ত অনেকের সাথে ১০ মিনিট বেশি গ্যাজাত দেখা যায় ফোনে। কারন যেই মেয়ে প্রেমের জন্য ছেলেদের নাম্বারে ফোন দিয়ে দিয়ে বেড়ায় সে ছ্যাঁচোড় না হয়ে যায় কোথায় !শিল্পীর বাবা নিষ্কর্মা মানুষ। তিন সন্তান জন্ম দানের পর চারিপাশের রঙ্গমঞ্চ দেখে নিজে থেকেই চুপসে গেছে। বাসায় ঢুকলে তার কাছে সবসময়ই চিড়িয়াখানা থেকে দুই আনা ভাল কিছু মনে হত না। কিন্তু সেই চিড়িয়াখানা আজ শ্মশান খানায় পরিনত হয়েছে। সেই শ্মশান খানা থেকে মাঝে মাঝে হয়ত ভ্যাপসা কারও ফোনে কথা বলার শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্বের নিস্করমতা তাকে এখনও গ্রাস করে আছে। ছ্যাপলার মত সব ব্যাপারেই তাকে হাঁসতে দেখা যায়। বড়ই অদ্ভুত মানুষ সে।বর্ষা কাল যেদিন শুরু হয় ঠিক তার তিন দিন পরে শিল্পীকে এক পাত্র পক্ষ দেখতে আসে। পাত্রের যোগ্যতা কিছু কম নয় বটে। কিন্তু সমস্যা একটাই তার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। সেই বউয়ের বাচ্চা হয় না। তাই তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মধ্যবয়স্কের শেষ সীমায় এসে তার নিজের একজন সঙ্গী আর উত্তরসূরি রেখে যাওয়ার চিন্তা তীব্র ভাবে তাড়া করতে থাকে। সেই তাড়াহুড়োর ব্যাতিবাস্ততায়ই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম শিল্পীদের সেই অসম্পূর্ণ গলিতে।শিল্পীর বাবা মায়ের আত্মিয়তার কোনই কমতি ছিল না। অন্য কিছু দিয়ে না হোক অন্তত আপ্যায়ন য় ে যেন তাদের মুগ্ধ করা যায়।ছেলের বড় চাচি আর ছেলে যেদিন আসে সেইদিন প্রায় ৩২ পদের আইটেম ছিল। এতটা আপ্যায়ন মনে হয় তারা এর আগে কাউকেই করে নি, এমনকি বড় মেয়ের সময়েও না। শিল্পীকে পরের বাড়ি পাঠানো যেহেতু নেহায়েত সহজ কাজ না তাইই এই আপ্যায়নের ছদ্মবেশ।-মেয়ের পড়াশুনা কতটুকু?-আই এ পাস। পড়াশুনায় ও অনেক ভাল। কিন্তু আই এ পাসের পরে আর পড়াশুনা করাই নি। মেয়ে মানুষ এত পড়াশুনা করবে, তারপরে কি? — কথাটা বলেই শাহানা বেগম বুঝে ফেললেন কথাটা বেফাঁসে হয়ে গেছে। শিক্ষিত ফ্যামিলির কাছে পড়াশুনা করিয়ে কি লাভ এই ধরনের প্রশ্ন রাখা চরমতম বোকামি। তবে এতে শাহানা বেগমেরও দোষ ছিল না, কারন তার এই নিয়ে পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই, এর আগে শিল্পীকে দেখতে কোন ছেলেপক্ষ আসে নি। আর বড় মেয়ের বিবাহের সময়ও তার এত জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দেবার প্রয়োজন হয় নি।-মেয়ে আর কি কি করতে পারে ? এই যেমন শখ বলতে।– সেলাই করতে পারে। আমার মেয়ের রান্নাও খুব সুন্দর আপা। আর সে খুব ভাল কবি লিখতে পারে।নার্সারির গন্ডিতেও পা না মাড়ানো শাহানা বেগমের কবিতার তা টা স্লিপ কেটে কবি হয়ে যায়।কিন্তু এত অসম্পূর্ণতার পরেও কবিতা হয়ত ছেলে পক্ষকে কিছুটা আকর্ষিত করতে পেরেছিল। বিশেষ করে রফিকুল ইসলামকে।ছেলে পক্ষ হাসি দিয়ে বিদায় হয়, সে ছিল এক রহস্যপূর্ণ হাসি। তার আড়ালে কি যেন একটা ছিল।সেই হাসির আবেশে বেশ কয়েকদিন ধরে শিল্পীর ফোনে কথা বলাটা বন্ধ হয়। ছেলে পক্ষ বলেছিল জানাবে। এ সময় অন্য কারও সাথে কথা বলা যায় না।বিশ্বাস করবেন না খালা, আমি যে কি খুশি হইছি– কি কস, এইডা কি আর বলতে। আমার মাইয়াটার একটা গতি হউক।-আল্লাহ যা করে ভালই করে , আমরাই খালি বুঝি না।-হহ রে, কিন্তু অয় গেলে আমি কেম্নে থাকমু। সারাদিন জ্বালাইত খালি।-শিল্পীর হয় না হয় না কইরাও কপালে ভাল একটা ছেলে জুটব ইনশাল্লাহ। বিয়া করা এটা কোন বিষয় না। কত শিক্ষিত ! আমনে এত টেনশন নিয়েন না।-হহ, ওইডাই, ভদ্র অনেক। ময় মুরুব্বিগরে সম্মান করতে জানে।-ব্যাবহার অনেক বড় ব্যাপার। আমরা সবাই শিল্পীর এই বিয়া নিয়া কত চিন্তা করছি। ছেলে পক্ষ শেষ পর্যন্ত কি কয়?– কয় মেয়ে ভাল, পছন্দ হইছি , জানাইবে সব। আরে রাজি যে দেইখাই বুঝা যায়, সব কি আর লগে লগে প্রকাশ করা যায়।-ওইটাই। দুই রাকাত নামাজ মানছি রে বাপ, সব যদি ঠিকমতন হয়। আল্লাই সব। আল্লাহ তুমি আমার মাইয়াটারে একটা গতি কর।লে পক্ষ যে কতটা রাজি ছিল তা এক সপ্তাহ পরেই বুঝা যায়। কবিতার জোরদারিটা খুব একটা টেকল না শেষ পর্যন্ত। কারন কেউ একজন ছেলে পক্ষকে বলেছিল, ক বিতার উদ্দেশ্য হয়ত অন্য কেউ। কিন্তু শাহানা বেগম শত চেষ্টা করেও কেউ একজনটার পরিচয় জানতে পারলেন না। কেন কেউ একজন চায় না শিল্পীর বিয়ে হোক? সে সংসার করুক, সুখি হোক, কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তার? কেন সে চাইবে না?শিল্পীর সংকটের এই জীবনেও শেষ পর্যন্ত আরও তিনটে প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু সেই অভিশপ্ত কারও উপস্থিতি বারেবারে শিল্পীর জীবনের সেই সুখটাকে কেঁড়ে নিচ্ছিল। কি রে মা, আমাগো জীবনটা আল্লায় এরকম বানাইছে ক্যান? বারে বারে ক্যান এরম হয়? (হু হু হু)-(নিশ্চুপ, প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে তার চরিত্রের চিত্রায়ন দেখে সে হতবাক, তার বলার মতন আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না)।-কার অভিশাপ লাগছে, কোন কুত্তার বাচ্চায় বারেবারে এরকম করে মাবুদ খোদায় জানে , আমি কিচ্ছু বুঝতাছি না, কিচ্ছু ভাল লাগতাছে না আমার।ই নিয়ে মোট চারটা প্রস্তাবই ফিরে চলে গেল। শিল্পীর জন্য এটা অনেক বড় একটা বিষয়। তবুও তার বিকারগ্রস্থতা খুব বেশি সময় টেকে না। এই ভয়ঙ্কর বিষয়গুলোতেও সে খুব একটা বিচলিত হয় না, যদিও কিছু সময়ের জন্য তাকে নিশ্চুপ পাওয়া যায়, কিন্তু কিছু পরেই ফিরে আসে কিশোরীর উৎফুল্লতা।ল্পীর এই চাঞ্চল্যতা কে যে মানুষটা সবচাইতে বেশি অপছন্দ করত সে শিল্পীর খালাতো ভাই, ফারুক। সেই ছো থেকেই সে শিল্পীকে দেখছে, কিন্তু শিল্পীর এরকম বেহাইয়াপনা আচরন তার কখনই ভাল লাগত না বিশেষ। শিল্পীর দুই বছরের বড় ছিল ফারুক, তবুও শিল্পী বড় ভাই হিসেবে ফারুককে সম্মান করত না খুব একটা। ফারুককে তুই তুই করে ডাকতো। শাহানা খালা কষ্ট পাবে বলে ফারুক কখনো কোন অব্জেকশনও তুলে নি, কিন্তু সে প্রচন্ডভাবে এই ব্যাপারটাকে অপছন্দ করত। আর শিল্পীকেও।কিরে তুই এইচ এস সি দিছস ! খবর কি ? রেজাল্ট তো দিল।খবর তো জানসই, আমার জিগাস ক্যান?জানি না আমি, কেউ বলে নাই তো। অবশ্য বলতে পারলে তো বলবে।-তুই আমার ঘরের থেকে বের হ – তোর ঘর ? ? এটা আমার খালার বাসা। তোর কথা মত যাইতে হবে না কি?-তোরে বের হইতে বলছি তুই বের হ। এই বাসায় আর আসবি না। লজ্জা থাকলে বের হ, যাবেশি ভাব কোন সময়ই ভাল না।তুই বের হফারুক শাহানা বেগমের বাসা থেকে আস্তে বের হয়ে যায়। সে আজকে অপমানিত হয়েছে ঠিক কিন্তু তা নিয়ে ফারুককে খুব একটা বিচলিত হতে দেখা যায় না। সে মনে মনে এক ধরনের আনন্দও পাচ্ছে। আনন্দের কারন শিল্পী ফেল করেছে। এরকম অহংকারী মেয়েদের ফেলই করা উচিত। যারা বড় কাউকে সম্মান করতে পারে না, মানুষকে কষ্ট দেয় তাদের সাথে এরকম হওয়াই উচিত। শিল্পী ফেল করাতে ফারুকের অন্য একটা খুশির কারন ছিল ফারুক নিজেও আই এ পাস। শিল্পী এই আই এ পাস টা করে ফেললে হয়ত তার দেমাগের ধাক্কায় আর বাচা যেত না। যাই হোক, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।ফারুক, তোর একটা বন্ধুরে দেখলাম যে, ওইটা কে রে?-রাহাত?-আমি তো আর নি না, ওই যে ওই দিন তোর সাথে ছিল যে, তোর অফিসে দেখছিলাম।-ও আচ্ছা, ওর নাম রাহাতই।-হুম্ম, পোলাটা কি করে রে?-কি করব? চাকরি করে।-কিসে?-সরকারি চাকরি। এলজিডির বড় অফিসারের সাথেই থাকে সবসময়। এলজিডির সব কাজের জন্য ওর হাত লাগে, কোটি কোটি টাকার কাজ ওর হাত দিয়া যায়।-অহ, পোলাটা দেখতে শুনতেও ভাল দেখলাম।-হুম, ভালই। বাপ মা’র এক ছেলে। ভাল খুব।-আচ্ছা ওর সাথে শিল্পীর , বুঝছসই তো বাবা। মাইয়াটা আমার……………-কিন্তু খালা……এই ধরনের ইনিকুয়ালিটির ব্যাপার স্যাপার ফারুককে বেশ বিরক্ত করত। যেখানে রাহাত বাবা – মায়ের এত বড় ছেলে, মোটামুটি একটা চাকরিও করে, সরকারি চাকরিতে পোস্ট যেমনই হোক, অবস্থা বেশ ভালই হয়, তাছাড়া রাহাতের কিছু ক্ষেত্রে সাইনও অনেক বড় ব্যাপার। এরকম একটা ছেলেকে শিল্পীর মত মেয়ের জন্য ভাবাটাও তো দুঃসাহস। যেখানে শিল্পীর চেহারা বাদ দিলেও আচার আচরণ সব কিছুই মূর্খের মত , পুরুষ মানুষ দেখলে ঢুলে পরে তার স্বভাব। অথচ এই দুঃসাহসের ব্যাপারটাই ইদানিং দেখাচ্ছেন শাহানা বেগম। কারন এখন দুঃসাহস ছাড়া তার গতি নাই আবার দুঃসাহসেও গতি নাই। ফারুক খালার মুখের সামনে বিশেষ কিছু বলতেও পারে নি।-কিরে ফারুক, রাহাতের কি অবস্থা? কিছু কইছিলি?-নাহ , আমি কি কমু? আমনে এগুলা কি বলেন? রাহাত কত কোয়ালিফাইড, এডুকেটেড একটা ছেলে। এটা হয় না কি!-আমার মাইয়ারে যারা দেখতে আসছে তারা কেউই কি কম ছিল না কি?-দুষ্ট গরু দিয়া ভরা গোয়াল আর কি। এগুলা কইয়া এখন কি লাভ খালা। আর আপনার মেয়ের স্বভাবও তো খুব একটা ভাল না। সে সারাদিন ফোনে এত কি করে? আপ্নেও তো ডাক দেন না, ঠিক কইরা ডাক দিলে আজকে এরকম হইত না।শাহানা বেগম আর কিছুই বললেন না, ফারুক বাকি যতটা সময় ছিল শাহানা বেগম চুপ করেই ছিলেন। তার বলার মতন কিছুই ছিল না। মেয়েটাকে যে খুব একটা মানুষ করতে পারে নি সে সেটাও বুঝতে পারছে ভালভাবেই।শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহে শিল্পীর ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল। বিষয়টা খুব একটা এগিয়েই ছিল। ডাক্তার বলেছিল তার পক্ষে বেশিদিন বাঁচা সম্ভব না। বেশি হলে তিন বছর। হাসপাতালের বিছানায় অনেক রোগীর মত তাকেও একটা বিরাট কক্ষে খাটের উপরে রাখা হয়েছে। প্রায়শই তার শরীর খারাপ করে। সপ্তাহে অন্তত একবার রক্ত পালটানোর দরকার হয়, আরও যাবতীয় কাজ ছিল।কোন এক শ্রাবণ মাসেই শিল্পীর মৃত্যু হয়েছিল, ব্রেন টিউমারের কারনে। গল্প লেখকদের শ্রাবণ মাসের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ আছে। সে কারনেই গল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো হয় শ্রাবণ মাসে। আকাশে তখন থাকে কালো মেঘ। হটাত সব কিছু অন্ধকার হয়ে ঘনিয়ে আসে। এরপরেই শুরু হয় মেঘের গর্জন। তারপর ঝুম বৃষ্টি। কালো মেঘের মতন জীবনের অংশগুলোও মলিন হয়ে যায়। কখনো কখনো ঝর হলে তো সব কিছুই লন্ডভন্ডও হয়ে যায়।তবে সেই শ্রাবনের মেঘ ঘনাবার আগে কতগুলো সুন্দর ঘটনাও ঘটেছিল। ফারুকের সাথে বিয়ে হয় শিল্পীর। ফারুক ছেলেটা আগে থেকেই ভালবাসত শিল্পীকে। সেই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়ত ছিল শিল্পীর বিয়ে ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে। ব্রেন টিউমারের পরে শিল্পী বেশিরভাগ সময়ই সেই লুকোচুরি খেলা ছেলেটাকে বারে বারে দেখতে পেত। হয়ত তার একাকীত্বের জন্য সেই মানুষটা বারে বারে সপ্নের মাঝে এসে ভিড় করত। প্রতিদিন মনে হয় সপ্নের মানুষটা আরও বেশি কাছে এসে পড়ছে। অনেকটা কাছে, আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে আসছে তার চেহারা।ফারুকের ব্যাবসার থেকে মন গিয়ে পরে থাকত শিল্পীর কাছে। যাকে সে দেখতে পারত না হটাত করে তার জন্যই খারাপ লাগতে শুরু করে। শত হোক, মেয়েটা আর কদ্দিনই বা বাঁচবে। তার উপরে জেদ ধরে থেকে কি লাভ। ফারুক ১ সপ্তাহের জন্য ব্যাবসা বাদ দিয়ে খালার বাড়ি চলে আসে। সবার ভাবনার তোয়াক্কা না করে সে শিল্পীর সাথে সাথে থাকত। শিল্পীর সাথে কত ধরনের অদ্ভুত সব গল্প করে বেড়াত। কোন এক শুক্রবারে হটাত সে শিল্পীকে নিয়ে বের হয় ঘুরবার জন্য। এরপরে তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। এই টাইপের রোগীরা বিশেষ করে সে যখন মেয়ে হয় তার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চায় না, কিন্তু সে না চাওয়াটা খুব একটা জোরালো হল না যখন সপ্নের সেই বোকা ছেলেটার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠা শুরু করে।ফারুক আর শিল্পীর একটা বাচ্চা হয়। তারা অনেক ভেবে তাদের ছেলের নাম রেখেছিল প্রকৃতি। নামটা মানুষের নাম হিসেবে চমৎকার রকম অদ্ভুত ছিল। প্রকৃতি সত্যই অদ্ভুত। সে সবসময় চায় এক ধরনের সেলফিশ জীনকে বাচিয়ে রাখতে। সে কখনো সেটাকে নষ্ট হতে দিতে চায় না। হয়ত তাদের বহন করা আর কপি করাই আমাদের চূড়ান্ত আর চরমতম উদ্দেশ্য। আর এ কারনেই গল্পের মৃত্যুপথযাত্রি মেয়েটা হটাত করে তার সপ্ন পুরুষ হিসেবে দেখতে পায় সবচাইতে অপছন্দ করা কাউকে। আর ছেলেটাও হটাত করে অসহায়ভাবে পাগল হয়ে যায় সেই ভ্যাপসা রঙের মেয়েটার প্রতি, যে একসময় পাড়ার ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নানান রকম ছ্যাস্রামি করে বেড়াত।

-

বসন্ত এখনো সাজঘরে আমি তাই নক্ষত্রের উত্তাপ নেই শীতার্ত শরীরে। হেমন্ত বালক, তুমি নাকি অদ্ভুত বৃষ্টি নামাও.. অসময়ে ভিজিয়ে দাও চন্দ্রমল্লিকার পালক! তবু তোমার অস্তিত্ব ভূলে যায় ফসলের রাত খুব ধীরে স্পর্শ করে শীতের নগ্ন হাত.. আমলকির ডাল ঘিরে ভীড় করে কুয়াশার দল; তৃষ্ণার্ত হৃদয় পান করে মুঠো মুঠো জোছনার জল। চারপাশে ছায়ারঙা শীত আর রূপালী ঘাস.. তারপর চন্দ্রবিলাস! এক ষ্টেশনের চায়ের স্টলটাতে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কলিমুদ্দীন। দোকানি সুরুজ আলীর সাথে খোশগল্প করতে করতে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খাচ্ছিলো সে। আহ্‌, ব্যাটা জব্বর চা বানায়। মন খালি আরো খাই আরো খাই করে। কাঁচের চ্যাপ্টা বয়ামের ভেতরে সাজানো বিস্কুটগুলোকে বড়ই লোভনীয় দেখাচ্ছিলো। আলগোছেই দু’টা বিস্কুট হাপিস করার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো। সুরুজ আলীর সাথে কথোপকথনটাও চালু রেখেছে। ভাবখানা এমন যেন মনের ভুলেই হাতটা ঐদিকে চলে গিয়েছে, অন্য কিছু নয়। সুরুজ আলী খুব যত্নের সাথে হাতটা টেনে সরিয়ে দেয়। ‘কলিম ভাই, আইজগা চা খাইয়্যাই খুশি থাহো। তুমার আগের দেনাই কইলাম পঞ্চাশ ট্যাহা হইছে।’ মনে মনে কষে একটা গালি দেয় কলিমুদ্দীন। ব্যাটা শকুনের চোখ নিয়ে দোকানদারি করে। ‘আরে সুরুজ ভাই, দুইখান বিস্কুট খাইলে ফকির হইবা নি? আচ্ছা থাউক। দিয়া দিমুনি তুমার ট্যাহা...’ কথা বলতে বলতেই তার চোখ চলে যায় ষ্টেশনের শেষ মাথায় পলায়নোদ্যোত এক নারী মূর্তির দিকে। শিউলী না? এই সময় এমন ভাবে কোথায় থেকে আসছে? নাকি যাচ্ছে? ভাবসাবে তো মনে হচ্ছে কলিমুদ্দীনকে দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি পালাচ্ছে। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখেই সোজা সেই দিকে হাঁটা দেয় কলিমুদ্দীন। সুরুজ আলী পেছন থেকে ডাকতে থাকে, ‘চললা কই? চায়ের দাম দিবা না? তুমার ট্রেন তো আইয়া পড়বো এহন।’ ‘এহুনি আইতাছি। আইয়া ট্যাহা দিতাছি।’ হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয় কলিমুদ্দীন। ‘হুঃ! আর দিছো!’ শ্লেষাত্মক উক্তিটি ছুড়ে দিয়ে কাজে মন দেয় সুরুজ আলী। ব্যাটা অকর্মা কোথাকার! সাত সকালে এসে দুনিয়ার আজাইরা প্যাচাল জুড়ে দিয়েছে। চা টাও খেয়ে গেলো মুফতে। কাজের সময়ে এইসব ‘ডিস্টাব’ একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না সে। এদিকে শিউলীকে ধরার জন্য পড়িমড়ি করে ছুটেও লাভ হলো না কলিমুদ্দীনের। শিউলী একেবারে হাওয়া। ঠিক আছে, সমস্যা নাই। দুপুরে বাড়িতে ফিরে এর হিসাব নেওয়া হবে। ষ্টেশনে ফিরে আসলো সে। শুনশান নীরবতা ভাঙতে শুরু করেছে। হকার থেকে শুরু করে যাত্রী, কুলি, এমনকি ষ্টেশনের দোকানগুলো পর্যন্ত আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। একটা চটজলদি প্রাণচাঞ্চল্য যেন পেয়ে বসেছে সবাইকে। প্রতিবার ট্রেন আসার আগের মুহুর্তের এই হই-হুল্লোড় খুব ভালো লাগে কলিমুদ্দীনের। জীবন যে থেমে যায়নি এই অনুভূতিটা সে টের পায় এই সময়। আজ প্রায় কুড়ি বছর যাবত সে এই ষ্টেশনে কুলিগিরি করে আসছে। এক্কেবারে বাচ্চা বয়সে অল্প কিছুদিন ট্রেনে হকারের কাজ করেছে। সেই কাজটা বড় ভালো লাগতো তার। অন্যরকম একটা উদ্দীপনা ছিল। কাঠি লজেন্স আর চানাচুর বিক্রি করতো সে। ষ্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে যাত্রীদের ভীড় ঠেলে উঠে যেতো ট্রেনে। তার সহকর্মী অন্য হকারেরা পেরে উঠতো না তার সঙ্গে। ফুড়ুৎ করে সবার আগেই তার ট্রেনে উঠে পড়া চাই। বিক্রিও ছিলো ভালো। কাঠি লজেন্স দেখে বাবা-মা’র কাছে বায়না ধরতো না এমন কোন ছোট বাচ্চা ছিলো না। আর তার চানাচুরও ভালো বিকোতো। কিন্তু তার বাপ তাকে এই কাজ বেশিদিন করতে দিলো না। ছোটবেলা থেকেই সে ছিলো তাগড়া ধরনের। হাতে পায়ে জোরও ছিলো প্রচুর। হকারের কাজে আর কয়টাকা মুনাফা থাকে? তার বাপ তাকে কুলিগিরিতে লাগিয়ে দিলো। নিজেও সে এই কাজ করতো । বাচ্চা কুলিদের উপর মানুষের একটা সমবেদনা থাকে। অপেক্ষাকৃত কম বোঝা তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়। কিন্তু পয়সার বেলাতে আবার দু’পয়সা বেশিই দেওয়া হয়। কাজেই শূন্য পুঁজি, ডাবল মুনাফা। কিন্তু কলিমুদ্দীনের ভালো লাগতো না এই কাজ করতে। বাচ্চা কুলিদের ওপর সব যাত্রীই যে সমবেদনা দেখাতো, এমনটা মোটেও ঠিক না। কেউ কেউ বেশ দু’পয়সা ঠকিয়েও দিতো। বাচ্চা বলে প্রতিবাদের কোনো সুযোগও তো ছিলো না। এই কাজ বেশি করতো বয়ষ্ক মানুষেরা। আপাতদৃষ্টিতে যাদের প্রাণে দয়া মায়া বেশি আছে বলে মনে হয়। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরাই বরং ঠিকঠাক টাকা দিয়ে দিতো। একবার মধ্যবয়ষ্ক একজন মানুষ তাকে ভাড়া দেবার নাম করে একেবারে বাসা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো। খালি বাসায় দরজা বন্ধ করে...। তারপর সেই লোক কলিমুদ্দীনকে ভয় দেখিয়েছিলো এই বলে যে, কাউকে বললে পুলিশ উল্টো তাকেই ধরে নিয়ে যাবে। আর পুলিশ ষ্টেশনে তার উপর কী কী হতে পারে তার একটা বর্ণণাও দিয়েছিলো সেই লোক। ভয়ে কাউকে বলেনি কলিমুদ্দীন। দু’দিন কাজেও যেতে পারেনি। বাবার কাছে শরীর খারাপের অযুহাত দেখিয়েছে। এরপর থেকে সেই বাচ্চা কলিমুদ্দীনও বুঝে গেছে, দুনিয়াটা সাপ খোপে ভরা। ঠিকমত পা ফেলে চলতে না পারলে নিজের প্রাণটাই বেঘোরে চলে যাবে। কাজ করার ব্যাপারেও একটা ঢিলেমি এসে গেছে এর পরে থেকে। একটুও মন চাইতো না পরিশ্রম করতে। কীভাবে বসে বসে টাকা পয়সা কামানো যায়, সেই বয়সেই তার উপায় রপ্ত করতে শুরু করে সে। কেউ তাকে ঠকিয়ে দু’পয়সা নিয়ে যাবে, এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। প্রয়োজনে আরেকজন কে ভেঙে খাবে, কিন্তু অহেতুক খাটা-খাটনি করে মরার ইচ্ছা নাই তার। দুই শিউলী আজ জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছে। আরেকটু হলেই পড়েছিলো বাঘের মুখে। উত্তর পাড়ার টিপু শাহের বউ আজ অনেকদিন যাবত তাকে একটা কাজের কথা বলছিলো। সকাল সকাল তার বাড়িতে গিয়ে উঠোনটা লেপে দেওয়া, গোয়ালের গরু বাছুরগুলোর খাওয়ার জোগাড়যন্ত্র করে দেওয়া আর আসার আগে উঠোনে ধান-কলাই শুকাতে দিয়ে আসা। বিকেলে এক ফাঁকে গিয়ে সেই ধান-কলাই আবার তুলে রেখে আসা। এইতো এতটুকুন কাজ। আর এটুকু কাজের জন্যই গৃহস্থ তাকে নগদ পাঁচশো টাকা করে মাসে মাসে দিবে। অতি লোভনীয় কাজ। শিউলীর বড় ইচ্ছে কাজটা করার। কিন্তু তার ‘লাটসাহেব’ স্বামীর জন্য কোন কাজের নামই সে মুখে আনতে পারে না। শুনলেই একেবারে খেকিয়ে উঠে। ‘খুব কাম করনের হাউশ লাগছে মনেত, তাই না? মাইনষের বাড়িত কাম করবার যাইয়া ইজ্জত নিয়া আর বাঁচন লাগবো না। দুইডা কম খাও ক্ষতি নাই, ইজ্জত ডুবানের কাম নাই।’ হাঃ ইজ্জত! একা একা অনেক দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে শিউলী। ইজ্জতের সংজ্ঞাটা যে কী তা সে বুঝতে পারে নাই। স্বামীর কুলিগিরি’র টাকায় সংসার চলে না। ঠিকমত কুলির কাজ করলে সংসার না চলার কোনোই কারণ নাই। কিন্তু তার স্বামী পরিশ্রম করার চেয়ে শুয়ে বসে আরাম করতেই ভালোবাসে বেশি। আর জানে বড় বড় গপ্পো ছাড়তে। তার দাদা-পরদাদারা কেউ এসব বেগার খাটতো না। তাদের ছিল বিঘা বিঘা জমি। ক্ষেত ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। সেই ক্ষেতের ধান আর পুকুরের মাছ তারা নিজেরা খেয়ে কখনোই শেষ করতে পারতো না। যুদ্ধের সময় তাদের সেই বিপুল সম্পদ চলে গেছে অন্য মানুষের দখলে। এরপর থেকেই এই গরীবি দশা। হু, বিপুল সম্পদ না ঘোড়ার ডিম! বিয়ের পর প্রথম প্রথম শিউলী স্বামীর চিকনাচাকনা সব কথাই বিশ্বাস করতো। ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে, সব কথাই ভুয়া। কোন সম্পত্তি ছিল না তার শ্বশুরকূলে। এরা সাত পুরুষই ষ্টেশনে কুলিগিরি করে আসছে। রেলওয়ে জংশনের কাছে বাড়ি হওয়ায় অন্তত খাওয়া পরার একটা বন্দোবস্ত জুটেছে। না হলে যে কর্মঠ স্বামী তার! হালচাষ তো তাকে দিয়ে জীবনেও হতো না। কিন্তু এতদিন তাও যা হোক কিছু একটা করে দিন চলে যেতো। গতবছর ছেলেটা জন্মাবার পরে থেকে খরচ বেড়ে গেছে। ছেলের দুধ কিনতে হয়। ঠিকমত বুকের দুধ পায় না, দু’মাসের পর থেকেই বাচ্চাকে তোলা খাওয়াতে হয়। তাই খরচে আর কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। এখানে ওখানে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। শিউলী জানে, তার স্বামী কোনদিনই এসব দেনা মিটাতে পারবে না। এখনো লোকজন ধার দিতে অপারগতা জানাচ্ছে না, কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সেই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হবে না। এই তো, গত মাসে ট্রাক ড্রাইভার কুতুব মিয়া এসেছিলো ধারের টাকা ফেরত চাইতে। কলিমুদ্দীন বাড়িতে ছিল না বলে রক্ষা। থাকলে মনে হয় ভালোই একটা ঝামেলা বাঁধতো। কুতুব মিয়া আবার আসবে বলে সেদিনের মতো বিদায় নিয়েছে। যাওয়ার সময় চোখের আশ মিটিয়ে একটা নির্লজ্জ দৃষ্টি দিয়ে গেছে শিউলীর দিকে। শিউলীর ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে সেই চোখের চাউনি। এই লোক তো মনে হয় না সহজে পিছু ছাড়বে। তাছাড়া তার স্বামী আর মানুষ পেলো না? একজন ড্রাইভারের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হবে! সেদিনের কথা শিউলী স্বামীকে বলতে ভোলে নাই। সেই চোখের চাউনী পর্যন্ত। কিন্তু কলিমুদ্দীন নির্বিকার। এসব নাকি শিউলীর মনের ভুল। একটা বড় কাজ পেলেই সব দেনা চুকিয়ে দেবে, এমন আশ্বাস বাণীতে ভরসা পায়নি শিউলী। চব্বিশ ঘণ্টা ভয়ে থেকেছে কখন না জানি আবার কুতুব মিয়া চলে আসে! বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নাই। গত পরশুদিনই আবার হানা দিয়েছে সে। এবার একেবারে ঝেড়ে কেশেছে কুতুব মিয়া। ‘জামাইরে কও হয় ট্যাহা দিক, নয়তো বাড়িত বন্ধক দেওনের কিছু থাগলে হেইডা দিক। হেহ্‌ হে...।’ সেদিনের পর থেকে আর শান্তিতে নাই শিউলী। তার স্বামীর উপর ভরসা করে কাজ নাই। যা করার তাকেই করতে হবে। তাই সে আজ গিয়েছিল টিপু শাহের বাড়ি। সকাল সকাল কাজ করে চলে আসবে। সেই সময়ে তো কলিমুদ্দীন বাসায় থাকে না। তার স্বামী জানতে না পারলেই হলো। বাচ্চাটাকে সাথে নিয়েই যাবে। ছেলেটা বড় শান্ত হয়েছে তার। কান্নাকাটি একেবারেই করে না। যেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানেই বসে থাকে। টিপু শাহের বউ তাকে কাজে রেখেছে। দুইশো টাকা অগ্রিমও দিয়েছে। সবকিছুই ঠিক ছিল। ফেরার পথে ষ্টেশনের ভেতর দিয়ে শর্টকাট মারতে গিয়েই ভেজালটা বেঁধেছে। কেন যে এত বড় ভুলটা করতে গেলো! তবে মনে হয় কলিমুদ্দীন তাকে দেখতে পায়নি। এই যাত্রায় বেঁচে গেছে সে। কাজটা করবে শিউলী। একটু একটু করে টাকা বাঁচিয়ে মিটিয়ে দেবে কুতুব মিয়ার সব পাওনা। ঘরের বাইরে গিয়ে ইজ্জত হারানোর আশংকা করছে তার স্বামী। কিন্তু ঘরে বসে থেকে ইজ্জত বাঁচারও তো কোন সম্ভাবনা দেখছে না শিউলী। ফুটবল খেলাটি বাঙালির নিজস্ব খেলার তালিকায় নেই। তবুও বাংলা অঞ্চলে ফুটবলকে নিছক ছেলেখেলা হিসেবে দেখা মুশকিল। কারণ ধীরে ধীরে বিদেশি এই খেলাটি মিশে গেছে আমাদের জীবনযাপন, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে। তাই ফুটবল নিয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাস শুরু থেকেই। বাঙালি লেখকদের লেখাজোকায়ও নানাভাবে এসেছে ফুটবলের প্রসঙ্গ। প্রমথ চৌধুরী ১৯১৫ সালে রচিত তাঁর ‘সাহিত্যে খেলা’ নামের এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যবিহীন।’ ওই প্রবন্ধে তিনি ‘উদ্দেশ্যবিহীন’ বলতে আনন্দদায়ক বোঝাতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, খেলা উদ্দেশ্যবিহীন এবং আনন্দদায়ক বলেই কলকাতার টাউন হলের দেশহিতকর বক্তৃতার চেয়ে ‘গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে’ মানুষ বেশি যায়। খেলা সম্পর্কে, বিশেষত ফুটবল খেলা সম্পর্কে, প্রমথ চৌধুরীর এই বক্তব্য খুবই সরল এবং বাছবিচারহীন বলেই মনে হয়। বাংলা অঞ্চলে ফুটবল খেলাকে ছেলেখেলা হিসেবে দেখা খুব মুশকিল। বাংলায় ফুটবলের সাংস্কৃতিক-রাজনীতি আছে, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার আছে, আছে শ্রেণিচরিত্র। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঙালির খেলাধুলার-সংস্কৃতির এন্তার বর্ণনা আছে। প্রাচীন সাহিত্য ঘেঁটেঘুঁটে দেখা যায়, আদিতে শিকার বা মৃগয়া বাঙালির খেলার একটা অংশ ছিল। নিম্নবর্গের বাঙালিদের কাছে শিকার ছিল জীবিকা ও ক্রীড়া দুই-ই। উচ্চবর্গের কাছে এটি ছিল শুধুই খেলা। বাংলা সাহিত্যের ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্য-এর ‘কালকেতুর বাল্যক্রীড়া’ উপশিরোনামে দেখা যায় সেখানে খেলা ও শিকার সমার্থক। কবির ভাষায়, ‘শিশুগণ সঙ্গে ফিরে, তাড়িয়া শশারু ধরে/দূরে পশু পালাইতে নারে।/বিহঙ্গ বাট্যুলে বধে/লতাতে জড়ায়ে বান্ধে/কান্ধে ভার বীর আস্যে ঘরে।’ শুধু মধ্যযুগের নায়ক কালকেতু কেন, বাংলাদেশে বর্তমানে জীবিত পুরোনো প্রজন্মের যাঁরা আছেন, তাঁরাও নিশ্চয় জানেন, শিকার তাঁদের কাছে একটা আনন্দময় খেলাই ছিল বটে। বাঙালির খেলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস বইয়ে বলেছেন, ‘কুস্তী বা মল্লযুদ্ধ এবং নানাপ্রকারের দুঃসাধ্য শারীর-ক্রিয়া ছিল নিম্ন কোটির লোকদের অন্যতম বিহার (পড়ুন: খেলা)। পবনদূতে নারীদের জলক্রীড়া এবং উদ্যান রচনার উল্লেখ আছে; এই দুটিই বোধ হয় ছিল তাঁহাদের প্রধান শারীর-ক্রিয়া। দ্যূত বা পাশাখেলা এবং দাবা খেলার প্রচলন ছিল খুব বেশি। পাশাখেলাটা তো বিবাহোৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ বলিয়াই বিবেচিত হইত।’ (পৃ. ৪৪৯)। দাবা খেলার প্রসঙ্গ তো বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ-এ হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যযুগের সাহিত্যে লাঠিখেলা, ঘোড়দৌড়ের উল্লেখও বেশ দেখা যায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ফুটবল খেলাটা বাঙালির নিজস্ব খেলার তালিকায় নেই। খাঁটি বাংলায় বলতে গেলে বাংলায় ফুটবলের ইতিহাস শুক্কুরে শুক্কুরে সাত দিনের ইতিহাস। বাংলামুলুকে ফুটবল খেলাটা ঢুকেছে মূলত ইংরেজ উপনিবেশের হাত ধরে। ইংরেজ রাজ-কর্মচারীরা তাঁদের বিকেলের সময় কাটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে এই খেলাটা খেলত। এক এলাকার রাজ-কর্মচারীরা অন্য এলাকার রাজ-কর্মচারীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে প্রতিযোগিতারও আয়োজন করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে (১৮৫৪-এর পর থেকে) কলকাতা ও ভারতের অপরাপর অঞ্চলে এই খেলার খেলোয়াড় এবং দর্শক দুটোই ছিল ইংরেজ। ক্রমে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলার ইংরেজ-সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণি। আরও পরে দর্শক হিসেবে ‘সাধারণ মানুষের’ সমাগম ঘটতে থাকে। তবে এই ‘সাধারণ’ বলতে নিশ্চয় খেটে খাওয়া মানুষ না। এই ‘সাধারণের’ও একটা শ্রেণি-পরিচয় ছিল। তারা অবশ্যই সেই শ্রেণি, যারা এ দেশে ইংরেজ শাসনের স্থানীয় খুঁটি হিসেবে কাজ করত অথবা পড়ালেখা শিখে যারা কালো চামড়ার ইংরেজ হয়ে উঠতে চাইত। হেয়ার স্কুলের ছাত্র ও ‘অভিজাত’ বংশের ছেলে নগেন্দ্রপ্রসাদের হাত ধরে ফুটবল বাঙালির মধ্যে খেলা হিসেবে প্রবেশ করে। হেয়ার স্কুলের এই ছাত্রটি নিশ্চয় ইংরেজ অনুকরণের মনোস্তত্ত্ব থেকে এ খেলাটা শিখতে চেয়েছিলেন। ১৮৮৪ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদ যখন তাঁর সমমনা বন্ধুদের নিয়ে ডালহৌসি ফুটবল ক্লাব গঠন করছেন, তার আগের দশকে বাঙালির ইংরেজ অনুকরণ নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) প্রমুখ রচনা করেছেন অসাধারণ অসাধারণ সব প্রহসন। যা হোক, নগেন্দ্রের ডালহৌসি ফুটবল ক্লাব বেশি দিন টেকেনি। অগত্যা ১৮৮৫-তে ‘শোভাবাজার ক্লাব’ নামে তিনি আরেকটি ক্লাব গঠন করেন। ক্লাবের নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইংরেজের ফুটবল কীভাবে স্থানীয় হয়ে উঠছে। ১৮৮৯-তে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আরেকটি স্থানীয় ক্লাব—মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব। শোভাবাজার ক্লাব ১৮৯২ সালে যখন ট্রেসড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ইংরেজ ক্লাব ‘ইস্ট সারে রেজিমেন্ট’কে হারিয়ে দেয়, তখন বাংলায় ফুটবলের নতুন মানে দাঁড়ায়। আরও নতুন মানে দাঁড়াল ১৯১১-এ, মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন শিল্ড কাপ জেতার পর। ফুটবল সে সময় আর নিছক ইংরেজ-অনুকরণের বিষয় হিসেবে না থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়। ১৯১১ সালের ২৯ জুলাইয়ের সেই ইংরেজ-বাঙালি খেলায় মানুষের ঢল নেমেছিল। এমনকি ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে হাজার হাজার মানুষ সেদিন গিয়েছিল কলকাতার সেই খেলা দেখতে। কেন গিয়েছিল? ওই দলের ১১ জনের ১০ জনই পূর্ব বাংলার খেলোয়াড় ছিল সে জন্য? শুধু তাই নয় বোধ হয়। তারও চেয়ে বেশি কিছু। এর অন্যতম কারণ বোধকরি স্বামী বিবেকানন্দের ফুটবল-সম্পর্কিত সেই বাণী, ‘পদাঘাতের বিপরীতে পদাঘাত কেবলমাত্র ফুটবলেই সম্ভব।’ ফুটবল সেদিন হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকাশের দারুণ এক অস্ত্র। ফুটবল খেলা সেদিন আর প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় শুধু ‘উদ্দেশ্যবিহীন’ আনন্দদায়ক খেলা রইল না, হয়ে উঠল ‘প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার’। ফুটবল যে সেই কালে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আবেগের বিষয় হয়ে উঠেছিল, এ কথা বিখ্যাত ঐতিহাসিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর ব্লাক হোল অব এম্পেয়ার (২০১২) বইয়ে সবিস্তারে দেখিয়েছেন। কথিত আছে ১৯১১-এ বঙ্গভঙ্গ যে রদ হয়েছিল, ফুটবলকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেই জাগরণ এর অন্যতম কারণ। হয়তো এ কথা মিথ, মানে মিথ্যার মতো, কিন্তু সত্যের চেয়েও বেশি সত্য। ১৯১১ সালের মোহনবাগানের জয় বাঙালির মধ্যে এত গভীর দাগ কেটেছিল যে এই জয় নিয়ে ১৩১৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যার মানসী পত্রিকায় করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এক কবিতা লেখেন। কবিতার একাংশ এরূপ,Ñ‘জেগেছে আজ দেশের ছেলে পথে লোকের ভীড়,/অন্তঃপুরে ফুটল হাসি বঙ্গরূপসীর।/গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,/আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।/আজকের এই বিজয়বাণী ভুলবে নাকো দেশ,/সাবাশ সাবাশ মোহনবাগান খেলেছ ভাই বেশ।’ এই কবিতাটি পরে গান আকারে গীত হয় এবং কলকাতায় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯১১-এ বাঙালির হাতে ইংরেজ যখন ফুটবলে পরাজিত হলো, কাজী নজরুল ইসলামের বয়স সে সময় ১২ বছর। তখন দারিদ্র্যের সঙ্গে অভাবনীয় সংগ্রামে রত এক কিশোর তিনি। এই কিশোর আর মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে ইংরেজের ভিত-কাঁপানো সব কাব্য-কবিতায় ভরিয়ে তুললেন বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার। ১৯২০-এর দশকের প্রায় পুরোটা সময় নজরুলের কেটেছে মূলত প্রবল ইংরেজ বিরোধিতায়। তাঁর বইয়ের পর বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জেল খেটেছেন ইংরেজবিরোধী কবিতা লেখার দায়ে। এই কবি যদি দেখেন আধিপত্যবাদী শোষক ইংরেজকে কোনো ফুটবল খেলায় বাঙালি ছেলেরা পরাজিত করেছেন, তখন তিনি কেমন উন্মাদনা বোধ করতে পারেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। সালটি ১৯২৮। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়। সেবার মোহনবাগান ক্লাব এক ইংরেজ ফুটবল ক্লাবকে (ডিসিএলআই?) পরাজিত করে। ইংরেজ উৎখাতই যাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়, তিনি বাঙালির এই জয়ে সৃষ্টিছাড়া আনন্দে ভাসবেন—এ আর নতুন কী! ফলে সেদিনের সেই জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন। উদ্দেশ্য ইংরেজ-বধ উদ্‌যাপন! কল্লোল যুগ বইয়ে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘সুতরাং খেলার মাঠ থেকে সোজা শেয়ালদা এসে ঢাকার ট্রেন ধরল তিনজন। দীনেশরঞ্জন, নজরুল আর নৃপেন।’ (পৃ. ১২৬)। কারণ হিসেবে অচিন্ত্য বলেছেন, ইংরেজের বিরুদ্ধে সেই খেলায় ঢাকার ছেলে মনা দত্ত বা রবি বোস বেশ কয়েকটা গোল দিয়েছিলেন। অচিন্ত্যের ভাষায়, ‘ঢাকার লোক যখন এমন একটা অসাধ্য সাধন করল তখন মাঠ থেকে সিধে ঢাকায় চলে না যাওয়ার কোনো মানে হয় না। যে দেশে এমন একজন খেলোয়াড় পাওয়া যায় সে দেশটা কেমন দেখে আসা দরকার।’ (পৃ. ১২৬)। আদতে সৃষ্টিছাড়া এক আনন্দে আত্মহারা হয়েই তিনি ঢাকা এসেছিলেন। গোলাম মুরশিদ তাঁর বিদ্রোহী রণক্লান্ত (২০১৮) বইয়ে নজরুলের সেবারের হঠাৎ ট্রেনে চেপে ঢাকা আসা সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিজের পরিবারকে বলে যাওয়ার বালাই নেই, সওগাতকে জানানোর দরকার নেই, প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। দায়িত্বহীনতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার দৃষ্টান্ত বটে।’ (পৃ. ৩১৮)। কিন্তু সত্যিই কি এটা ‘দায়িত্বহীনতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা’! নাকি ইংরেজ-বধের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ! ইংরেজকে ফুটবলে পরাজিত করার মধ্যে কি নজরুল তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন মাতৃভূমির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেখে আত্মহারা হয়েছিলেন! ব্যক্তিটি যখন নজরুল তখন তাই হওয়াটাই তো স্বাভাবিক! ফুটবল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যেমন শাণিত করেছে তেমনি বিতর্কও কম তৈরি করেনি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফুটবল এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে সাহিত্যে খেলার প্রসঙ্গ মানেই ফুটবল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শ্রীকান্ত (১৯১৭) উপন্যাসে ফুটবল খেলার এক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ। সন্ধ্যা হয় হয়। মগ্ন হইয়া দেখিতেছি। আনন্দের সীমা নাই। হঠাৎÑ ওরে বাবাÑএ কি রে! চটাপট্ শব্দ এবং মারো শালাকে, ধরো শালাকে!...পাঁচ-সাতজন মুসলমান-ছোকরা তখন আমার চারিদিকে ব্যূহ রচনা করিয়াছেÑপালাইবার এতটুকু পথ নাই।’ (শ্রীকান্ত, প্রথমপর্ব, পৃ.Ñ২) শরতের এই ‘বাঙ্গালী’ এবং ‘মুসলমান’ দল বিভাজন উত্তরকালে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি শরৎচন্দ্র মুসলমানদের বাঙালি মনে করতেন না! নাকি শরৎচন্দ্র সমকালের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছিলেন মাত্র। এ এক ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়ই বটে! মিলন আর দ্বন্দ্ব যা-ই সৃষ্টি করুক না কেনো বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে ফুটবল খেলা বাংলা অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বর্তমানে ফুটবল গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে প্রবেশ করলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে অবিভক্ত বাংলায় ফুটবল ছিল মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকর্ষণীয় খেলা। ফুটবল যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির খেলা ছিল তা জসীমউদ্‌দীনের হাসু (১৯৩৮) কাব্যগ্রন্থের ‘ফুটবল খেলোয়াড়’ কবিতা দেখলেই বোঝা যায়। এই কবিতায় দেখা মেলে জসীমউদ্‌দীনের কাব্য-কবিতার মধ্যে সবচেয়ে ‘স্মার্ট’ নায়ককে—ইমদাদ হক। সোজন, রূপাই নামের বিপরীতে এই নাম ‘স্মার্ট’ আর নির্দিষ্ট শ্রেণি-চিহ্নিতই বটে। আবার এই যুবক থাকেও শহরের ‘মেসে’। কবির ভাষায়, ‘আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়।’ সমকালের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ফুটবল কী এক তীব্র উন্মাদনা ছড়িয়েছিল তার এক বিশ্বস্ত ছবি পাওয়া যায় এই কবিতায়। ইমদাদ হককে সকালবেলা গিঁটে গিঁটে মালিশ আর সেঁক দিতে দিতে মেসের চাকর ‘লবেজান’ হয়ে যায়। সবাই ভাবে ইমদাদ ‘ছমাসের তরে পঙ্গু যে হল হায়’। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় দেখা গেল ‘বাম পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা,/ভাঙা কয়খানা হাতে-পায়ে তার বজ্র করিছে খেলা।’ ফুটবল আনন্দদায়ক খেলা—এটা যেমন সত্যি, তেমনি এ-ও সত্যি যে ফুটবলের সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক-রাজনৈতিক পরিচয় আছে। আছে সাহিত্যের অন্দরমহলে হানা দেওয়ার মতো অসামান্য ক্ষমতা। আছে প্রবল সম্মোহনী শক্তি। আপাত নিরীহ এই খেলাটার মধ্যে আছে ইতিহাসের সরল-জটিল সব অলিগলি আর আলো-আঁধার। তিন গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে একটা কথাও বলে না কলিমুদ্দীন। আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। তারপর আয়েশ মতো একটা বিড়ি ধরিয়ে ডাক দেয় শিউলীকে। ‘আইজ কই গেছিলি?’ চমকে ওঠে শিউলী। ও, তাহলে নজর এড়ায় নাই। এইসব দিকে নজর ঠিকমতো আছে। জানে সে, মিথ্যা বলে লাভ নেই কোনো। তাই মাথা সোজা রেখেই বলে, ‘টিপু শাহের বাড়িত গেছিলাম। কামডা নিছি আমি।’ ‘এঃ! কামডা নিছি আমি! তুই নেওনের মালিক হইলি কুন্দিন থনে? আমি করবার দিমু ভাবছোস? ঐ টিপু শাহ্‌ লোক কেমুন জানোস কিছু?’ ‘হেইডা জাইন্যা আমার কী? আমি আমার কাম কইর্যান চইল্যা আইমু।’ ‘এঃ! কাম কইর্যাস চইল্যা আইমু! তোরে আইবার দিলে তো! আমের আঁঢির লাহান চুইষ্যা খাইবো, বুঝছোস?’ ‘আর, ঘরেত বইয়্যা থাহলে আপনের ডেরাইভার আমারে চুইষ্যা খাইবো।’ ‘খালি মুহে মুহে কতা। আমি করবার দিমু না। ব্যস, এইডা আমার শ্যাষ কথা। এর পরেও যুদি করার ইচ্ছা থাহে, তোরে আমি তালাক দিমু।’ এইটা শুনে আর কথা সরে না শিউলী’র মুখ থেকে। একেবারে বোবা হয়ে যায় সে। ওদের চেঁচামেচিতে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে বাচ্চাটা। শিউলী দৌঁড়ে গিয়ে বুকে নেয় তাকে। মায়ের বুকের ওমে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে। কলিমুদ্দীন দুমদাম দাম্ভিক পা ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সেদিন বিকেলেই একটা ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটে। চলমান ট্রেন থেকে যাত্রীর কাছ থেকে মাল-সামান নিতে গিয়ে অসাবধানে কলিমুদ্দীনের একটা পা চলে যায় ট্রেনের চাকায়। চোখের পলকেই পা টা একেবারে থেঁতলে যায় তার। ষ্টেশনের বিপুল কোলাহল আর শোরগোলের মাঝেই ভীষণরকম বেমানানভাবে অসার, নিঝুম হয়ে আসে কলিমুদ্দীনের জগতটা। চার ডান পা টা কেটে ফেলতে হয় কলিমুদ্দীনের। শুরু হয় তার অন্য জীবন। হাতে সামান্য যে ক’টাকা গচ্ছিত ছিল, চিকিৎসা বাবদ সেটাও চলে যায়। পুরোপুরি পথে বসে যায় পরিবারটি। এক কামরার ছোট্ট যে বাসায় তারা থাকতো তার যৎসামান্য ভাড়া মেটানোও আর সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। বাকী পড়ে যায় বেশ কয়েক মাসের ভাড়া। বাড়িওয়ালা প্রথম কিছুদিন এসে উহুঁ আহা করে যায়। আস্তে আস্তে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একসময় ভাড়া দেওয়ার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে। বাচ্চাটার দুধ কেনা হয় না। ঠিকমত ভাতই জুটে না এখন, আর দুধ! ভাতের ফেন, একটু সুজি....যখন যা পারে তাই খাওয়াতে শুরু করে বাচ্চাটাকে। একবছরের শিশুও বুঝি বুঝে যায় যে, এখন মর্জি করলে চলবে না। তাই যা পায়, সেটুকুই চেটেপুটে খেয়ে নেয়। এর মধ্যে গজবের মতো একদিন এসে উপস্থিত হয় ড্রাইভার কুতুব মিয়া। কলিমুদ্দীনকে পেয়ে খিস্তি খেউড়ের মাতম উঠায়। এতদিন ধরে ধার নিয়ে বসে আছে। তার টাকা মেরে খেলে সে কলিমুদ্দীনকে জানে মেরে ফেলবে এই হুমকিও দিয়ে যায়। ফেরার পথে উঠোনে একা পেয়ে শিউলীর কানে কানে বলে যায়, ‘ল্যাংড়া জামাই লইয়্যা আর কী ঘর করবা গো সুন্দরী? কুপ্রস্তাব দিতাছি না। ভাইব্যা দেহো। বিয়্যা করমু তুমারে। রাজি থাগলে কও। তুমার জামাইয়ের দেনাও মাফ কইর্যা দিমু তাইলে। এই লও আমার ঠিহানা। বাচ্চা নিয়্যা আইলেও রাজি আছি।’ শিউলী ছুটে ঘরে এসে জামাইয়ের অবশিষ্ট পা টা চেপে ধরে। ‘আপনার দুহাই লাগে। আমারে এইবার কাম করনের অনুমতি দ্যান। নাইলে আমরা কেও বাঁচবার পারুম না। আপনি আমার লাইগ্যা চিন্তা করবেন না। আমি বাঁইচ্যা থাকতে আমার ইজ্জত খুইতে দিমু না। আমারে আপনি কাম করবার দ্যান। আমার বাচ্চাডারে বাঁচাইবার দ্যান।’ কলিমুদ্দীন দার্শনিকের মতো বলে, ‘বউ, ইজ্জত হইলো বেবাকের আগে। এইডা বুঝোন লাগবো। মাইনষ্যের বাড়িত কাম করলে হেই ইজ্জতের কিছুই বাকি থাগবো না। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি উপায় ভাইব্যা থুইছি। কাল থিইক্যা ইস্টেশনে বসমু আমি। গ্যাদারে লগে দিও। মাইনষ্যে ছোডো বাচ্চা দেহলে ট্যাহা দিইয়্যা ভরাইয়্যা দেয়। তুমি বাড়িত বইস্যা ট্যাহা গুইন্যা শ্যাষ করবার পারবা না।’ শিউলী বিষাক্ত চোখে তাকায় কলিমুদ্দীনের দিকে। ভাগ্যিস, সেই দৃষ্টির ভাষা পড়বার মতো যোগ্যতা কলিমুদ্দীনের নেই। পরদিন সকাল বেলাতেই কলিমুদ্দীন একটা মাদু্র আর টাকা রাখবার একটা ডিব্বা নিয়ে ষ্টেশনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। চিকিৎসার সময় সদর হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব তাকে দয়া করে একজোড়া পুরনো স্ক্র্যাচ দিয়েছিলেন। সেটার সাহায্যেই সে বেশ একা একা চলতে পারে। যাওয়ার আগে শিউলীকে বলে যায়, ‘ও বউ, আমি যাইতাছি। তুমি এট্টু পরে গ্যাদারে লইয়্যা যাইয়ো।’ শিউলী তাকিয়ে তাকিয়ে তার স্বামীর চলে যাওয়া দেখে। পরাজিত, জীবন থেকে পলায়নকারী একজন মানুষ। অথচ, তার চালচলনে এখনো কেমন ইজ্জতের বড়াই! ঠিকই তো, ইজ্জতটা চলে গেলে আর কী থাকবে? শিউলী নিজেও তৈরি হয়ে নেয়। বিয়ের সময়ের টিনের ট্রাঙ্কটা বের করে ওর কাপড়গুলো গুছিয়ে নেয়। বাচ্চাটার কাপড়গুলোও ভরে নেয়। শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখে স্বামীর বাড়ির দিকে। ওর নিজের হাতে গোছানো সংসার, হাড়িকুড়ি, চুলার পাড়, দেয়াল ঘেঁষে ওরই হাতে লাগানো পুঁইয়ের চারা। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে। তিনরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে যায় শিউলী। রাস্তা ঘুরে গেছে তিন দিকে। তার বাপের বাড়ির পথ চলে গেছে ডানদিকে। আসা যাওয়া নাই কতদিন! কী জানি! রাস্তাটা আগের মতোই হাঁটার যোগ্য আছে, নাকি খানাখন্দে ভরে গেছে! বাঁয়ের সরু পথটা যে গন্তব্যে গেছে সেই ঠিকানা তার হাতে্র মুঠোয় ধরা। এই পথে কোনোদিন চলেনি সে। ঠিকঠাক পথের দিশা খুঁজে পাবে কিনা তা তার অজানা। সামনের সোজা পথটা অনেক চওড়া, সমতল...এতটুকুও বন্ধুর নয়। হাতছানি দিয়ে শিউলীকে যেন ডাকছে সে পথ। কিন্তু শিউলীর জানা নেই সেই পথের শেষে সে কোন গন্তব্যের দেখা পাবে। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাতে থাকে সে। পথচলতি দু’চারজন মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে। একেকজনের চোখে একেকরকম প্রশ্ন। সব প্রশ্নের ভাষা একেবারে অজানা নয় শিউলীর। বাচ্চাটার মুখের দিকে পূর্ণচোখে একবার তাকায় সে। একটা কোনো ইঙ্গিতের আশায়। বেশি সময় নেওয়া যাবে না। খুব তাড়াতাড়িই একটা পথ তাকে বেছে নিতে হবে। ভ্যাপসা আচমকা বৃষ্টিটা থেমে গেল। এরপরেই শুরু হল মেঘের গর্জন। কিছুক্ষন পর সব কিছু পরিস্কার। বৃষ্টির জন্য রাস্তার মাঝে পানির গড় উচ্চতা ছিল ১০ মিমি। কোথা থেকে একটা কাক এসে যেন পানির মাঝে কি খোঁজা শুরু করল। মেয়েরা আংটি হারালে যেরকম করে খুঁজে। কিন্তু কাকের তো আংটি নেই সে কি খুজবে পানির মাঝে ! এই বিষয়টা নিয়ে মেয়েটা খুব কৌতূহলী এবং বিরক্ত। কারন সে জানতে পারছে না কাকটা কি খুজছে। কাকের কান্ড কারখানার দর্শকই হচ্ছে আমার গল্পের নায়িকা। চোখের মাঝে যেন একটা বিল ঢুকে আছে। চাহনি দিয়েই সম্মোহনের এক অপূর্ব ক্ষমতা রাখে সে। খুব অল্প কিছু মানুষই তাদের জীবনে এরকম অদ্ভুত সুন্দর কারো দর্শন পায়। এমনই অপূর্ব রূপবতী ছিল আমার গল্পের নায়িকা। যারা বর্ণনা গুলো পরে আগ্রহ পাচ্ছেন তাদের জন্য দুঃখিত। কারন মেয়েটা এরকম বিশেষ সুন্দরী কিছুই ছিল না। ইটের দেয়াল পুরানো হয়ে গেলে তার উপরে যেমন একটা ভ্যাপসা রঙ পরে মেয়েটার রঙ ছিল সেরকমই। শ্যামলার চাইতে নিচে। চেহারায়ও বিশেষ সুন্দরের কোন ছাপ ছিল না। গল্প এদ্দুর পরে অনেকেই রেখে দেবেন, কারন কুৎসিত মেয়েদের নিয়ে গল্পগুলো কল্পনা করতে এক ধরনের অস্বস্তি লাগে। বিরক্তি হয়। সৌন্দর্য অনেক বড় একটা ব্যাপার। তাই গল্পের নায়িকাগুলো চমৎকার সুন্দরী হয়। লোকে আগ্রহ পাবে তবে। শিল্পির অনেকদিন ধরেই একটা ইচ্ছে ছিল; একটা সাদা শাড়ি কিনবে। কারন সেবারের পহেলা বৈশাখে সাদা শাড়ি লাল পারের একটা শাড়ি দেখেছিল একটা মেয়ের গায়ে। আগে সাদা শাড়ি দেখলেই বিধবা সাইন মনে হত, কিন্তু মেয়েটার গায়ে শাড়িটা দেখে তার এতটা ভাল লেগেছিল যে সে এই জিনিসটা নিয়ে বেশ কয়েকবার সপ্নও দেখেছে। প্রথম স্বপ্নটা ছিল শিল্পি সাদা শাড়ি পরে কাশফুলের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে । কে তার চেহারাটা বুঝে উঠা মুশকিল। এক ধরনের লুকোচুরি খেলা। কিন্তু ছেলেটা একটু বোকা টাইপের, সে শিল্পিকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর কিছু সময় পরে পরেই অস্থির হয়ে উঠছে। শিল্পির জীবনে এটাই প্রথম সপ্ন যেটা সে অনেক সময় ধরে মনের আশ মিটিয়ে দেখতে পেরেছিল।সাদা শাড়ির কথা শিল্পি মাকে অনেক বলেছিল। কিন্তু মা বিশেষ পাত্তা দেয় নি। শিল্পীর মা আসলে তাকে বুঝাতে চাচ্ছে না যে সাদা শাড়িতে শিল্পিকে মোটেই ভাল লাগবে না। কারন সাদা শাড়ির আড়ালে ভ্যাপসা কেউ। মোটেই মানাবে না। অনেক কৌশল করেও শিল্পীর মা তাকে সেটা বুঝাতে পারে নি। যদি তার অনেক টাকা থাকত তাহলে সে মেয়েটাকে অবশ্যই সাদা শাড়ি দিত। এমনকি না মানালেও। কিন্তু যাদের কাছে অনেক টাকা থাকে না তাদের কে বেছে বেছে কিনতে হয়। মানানো না মানানোর বিষয়গুলো নিয়ে অনেক ভাবতে হয়। অথচ ২৪ বছরের এই মেয়েটাকে সেই সহজ কথাটা বুঝানো যাচ্ছে না। বিয়ে করালে ঠিক সময়ে এখন এর একটা বাচ্চা থাকত।– মা, জান কালকে রাত্রেও সপ্নে দেখি আমি সাদা শাড়িতে, একটা নৌকার উপরে । চারিপাশে পানি আর পানি , চলন বিল।– তোর বয়স কত?– ২৪-২৫ ক্যান?-আমি এরকম সপ্ন দেখতাম ১৫ বছর বয়সে। তোর মাথায় কি কিছু নাইরে শিল্পি। এত বড় হইছস। কি অবস্থা সংসারটার। আর তার মইদ্ধে…-থাক হইছে, আর চিল্লাফাল্লা কইরো না, তোমার চিল্লাফাল্লায় কান ঝালাফালা হইয়া যায় ।শিল্পির মা কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। শাহানা বেগমের তিন মেয়ে। শিল্পি মেঝ। অথচ তার আচরণে মনে হয় সেইই যেন সবার ছোট। শিল্পীর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট বোনটা তার স্কুলের এক ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। সংসারে এখন শুধু শিল্পীই একা। শাহানা বেগমের এই বয়সে এসে কাউকে নিজের সাথে সাথে সবসময় রাখতে ইচ্ছে করে। শিল্পীর বিয়ে নিয়ে তাই তার বিশেষ কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু তারপরেও মাথা ব্যাথা আনতে হয়। কারন মেয়েটার বয়স হয়ে যাচ্ছে। এর যদি এখন বিয়ে দেয়া না যায় ……… । ‘ মেয়েটা আমার একটু রংচটা বলে………… মানুষ কে কি শুধু চেহারার সুন্দর দিয়েই বিবেচনা করা যায় ! ? ? মনের কি কোনই দাম নে ই !’ খুব সম্ভবত যাদের চেহারা সুন্দর না তারাই এমনটা ভাবে।এত অসৌন্দরযের মাঝেও, কেউ হয়ত সত্যিই শিল্পীর সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিল। যাকে সে প্রায়ই সপ্নে দেখত, কিন্তু কখনই মানুষটার সম্পূর্ণ মুখ দেখে উঠতে পারে নি। হয়ত তাকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ একজন যদি সৌন্দর্য খুঁজে নাইই পায় তবে প্রকৃতির উদ্দেশ্য সফল হবে কি করে। প্রকৃতি সবসময়ই একটা বন্ড পেয়ার তৈরি করে। আমাদের জীনের এলিলে এক্স আর ওয়াই এর শতকরা মান ৫০% করে। কিছু মারাত্মক রকম স্বার্থপর জীনকে ট্রান্সফারের জন্য প্রকৃতি আমাদের প্রোগ্রাম করে রাখছে, এখানে সে প্রত্যেকের জন্যই কোন না কোন একজনকে ঠিক করে রেখেছে। সেই ঠিক করা মানুষটাকে শিল্পী চিনে উঠেও চিনতে পারছে না।স্বভাবতই যৌবনে প্রেম ভালবাসা করতে না পারার কারনে শিল্পীর মনের প্রেমের অতৃপ্ত শুন্য স্থানটা আরও গভির হতে থাকে। এই কারনেই পাঁচ টাকার নোটের উপরে লিখা নিঃস্বার্থ প্রেমিকদের নাম্বারে তাকে প্রায়ই ফোন করতে দেখা যায়। এদের সাথে শিল্পীর কথাবার্তা খুব একটা এগোয় না। কারন এই নিঃস্বার্থ প্রেমিকরা ছেঁচোড়ের দলে। শিল্পী এখনো তাদের মত হতে পারে নি। কিন্তু চারিদিক তাকে ক্রমশই ছেঁচোড় করে তুলছে। এখন হয়ত অনেকের সাথে ১০ মিনিট বেশি গ্যাজাত দেখা যায় ফোনে। কারন যেই মেয়ে প্রেমের জন্য ছেলেদের নাম্বারে ফোন দিয়ে দিয়ে বেড়ায় সে ছ্যাঁচোড় না হয়ে যায় কোথায় !শিল্পীর বাবা নিষ্কর্মা মানুষ। তিন সন্তান জন্ম দানের পর চারিপাশের রঙ্গমঞ্চ দেখে নিজে থেকেই চুপসে গেছে। বাসায় ঢুকলে তার কাছে সবসময়ই চিড়িয়াখানা থেকে দুই আনা ভাল কিছু মনে হত না। কিন্তু সেই চিড়িয়াখানা আজ শ্মশান খানায় পরিনত হয়েছে। সেই শ্মশান খানা থেকে মাঝে মাঝে হয়ত ভ্যাপসা কারও ফোনে কথা বলার শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্বের নিস্করমতা তাকে এখনও গ্রাস করে আছে। ছ্যাপলার মত সব ব্যাপারেই তাকে হাঁসতে দেখা যায়। বড়ই অদ্ভুত মানুষ সে।বর্ষা কাল যেদিন শুরু হয় ঠিক তার তিন দিন পরে শিল্পীকে এক পাত্র পক্ষ দেখতে আসে। পাত্রের যোগ্যতা কিছু কম নয় বটে। কিন্তু সমস্যা একটাই তার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। সেই বউয়ের বাচ্চা হয় না। তাই তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মধ্যবয়স্কের শেষ সীমায় এসে তার নিজের একজন সঙ্গী আর উত্তরসূরি রেখে যাওয়ার চিন্তা তীব্র ভাবে তাড়া করতে থাকে। সেই তাড়াহুড়োর ব্যাতিবাস্ততায়ই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম শিল্পীদের সেই অসম্পূর্ণ গলিতে।শিল্পীর বাবা মায়ের আত্মিয়তার কোনই কমতি ছিল না। অন্য কিছু দিয়ে না হোক অন্তত আপ্যায়ন য় ে যেন তাদের মুগ্ধ করা যায়।ছেলের বড় চাচি আর ছেলে যেদিন আসে সেইদিন প্রায় ৩২ পদের আইটেম ছিল। এতটা আপ্যায়ন মনে হয় তারা এর আগে কাউকেই করে নি, এমনকি বড় মেয়ের সময়েও না। শিল্পীকে পরের বাড়ি পাঠানো যেহেতু নেহায়েত সহজ কাজ না তাইই এই আপ্যায়নের ছদ্মবেশ।-মেয়ের পড়াশুনা কতটুকু?-আই এ পাস। পড়াশুনায় ও অনেক ভাল। কিন্তু আই এ পাসের পরে আর পড়াশুনা করাই নি। মেয়ে মানুষ এত পড়াশুনা করবে, তারপরে কি? — কথাটা বলেই শাহানা বেগম বুঝে ফেললেন কথাটা বেফাঁসে হয়ে গেছে। শিক্ষিত ফ্যামিলির কাছে পড়াশুনা করিয়ে কি লাভ এই ধরনের প্রশ্ন রাখা চরমতম বোকামি। তবে এতে শাহানা বেগমেরও দোষ ছিল না, কারন তার এই নিয়ে পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই, এর আগে শিল্পীকে দেখতে কোন ছেলেপক্ষ আসে নি। আর বড় মেয়ের বিবাহের সময়ও তার এত জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দেবার প্রয়োজন হয় নি।-মেয়ে আর কি কি করতে পারে ? এই যেমন শখ বলতে।– সেলাই করতে পারে। আমার মেয়ের রান্নাও খুব সুন্দর আপা। আর সে খুব ভাল কবি লিখতে পারে।নার্সারির গন্ডিতেও পা না মাড়ানো শাহানা বেগমের কবিতার তা টা স্লিপ কেটে কবি হয়ে যায়।কিন্তু এত অসম্পূর্ণতার পরেও কবিতা হয়ত ছেলে পক্ষকে কিছুটা আকর্ষিত করতে পেরেছিল। বিশেষ করে রফিকুল ইসলামকে।ছেলে পক্ষ হাসি দিয়ে বিদায় হয়, সে ছিল এক রহস্যপূর্ণ হাসি। তার আড়ালে কি যেন একটা ছিল।সেই হাসির আবেশে বেশ কয়েকদিন ধরে শিল্পীর ফোনে কথা বলাটা বন্ধ হয়। ছেলে পক্ষ বলেছিল জানাবে। এ সময় অন্য কারও সাথে কথা বলা যায় না।বিশ্বাস করবেন না খালা, আমি যে কি খুশি হইছি– কি কস, এইডা কি আর বলতে। আমার মাইয়াটার একটা গতি হউক।-আল্লাহ যা করে ভালই করে , আমরাই খালি বুঝি না।-হহ রে, কিন্তু অয় গেলে আমি কেম্নে থাকমু। সারাদিন জ্বালাইত খালি।-শিল্পীর হয় না হয় না কইরাও কপালে ভাল একটা ছেলে জুটব ইনশাল্লাহ। বিয়া করা এটা কোন বিষয় না। কত শিক্ষিত ! আমনে এত টেনশন নিয়েন না।-হহ, ওইডাই, ভদ্র অনেক। ময় মুরুব্বিগরে সম্মান করতে জানে।-ব্যাবহার অনেক বড় ব্যাপার। আমরা সবাই শিল্পীর এই বিয়া নিয়া কত চিন্তা করছি। ছেলে পক্ষ শেষ পর্যন্ত কি কয়?– কয় মেয়ে ভাল, পছন্দ হইছি , জানাইবে সব। আরে রাজি যে দেইখাই বুঝা যায়, সব কি আর লগে লগে প্রকাশ করা যায়।-ওইটাই। দুই রাকাত নামাজ মানছি রে বাপ, সব যদি ঠিকমতন হয়। আল্লাই সব। আল্লাহ তুমি আমার মাইয়াটারে একটা গতি কর।লে পক্ষ যে কতটা রাজি ছিল তা এক সপ্তাহ পরেই বুঝা যায়। কবিতার জোরদারিটা খুব একটা টেকল না শেষ পর্যন্ত। কারন কেউ একজন ছেলে পক্ষকে বলেছিল, ক বিতার উদ্দেশ্য হয়ত অন্য কেউ। কিন্তু শাহানা বেগম শত চেষ্টা করেও কেউ একজনটার পরিচয় জানতে পারলেন না। কেন কেউ একজন চায় না শিল্পীর বিয়ে হোক? সে সংসার করুক, সুখি হোক, কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তার? কেন সে চাইবে না?শিল্পীর সংকটের এই জীবনেও শেষ পর্যন্ত আরও তিনটে প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু সেই অভিশপ্ত কারও উপস্থিতি বারেবারে শিল্পীর জীবনের সেই সুখটাকে কেঁড়ে নিচ্ছিল। কি রে মা, আমাগো জীবনটা আল্লায় এরকম বানাইছে ক্যান? বারে বারে ক্যান এরম হয়? (হু হু হু)-(নিশ্চুপ, প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে তার চরিত্রের চিত্রায়ন দেখে সে হতবাক, তার বলার মতন আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না)।-কার অভিশাপ লাগছে, কোন কুত্তার বাচ্চায় বারেবারে এরকম করে মাবুদ খোদায় জানে , আমি কিচ্ছু বুঝতাছি না, কিচ্ছু ভাল লাগতাছে না আমার।ই নিয়ে মোট চারটা প্রস্তাবই ফিরে চলে গেল। শিল্পীর জন্য এটা অনেক বড় একটা বিষয়। তবুও তার বিকারগ্রস্থতা খুব বেশি সময় টেকে না। এই ভয়ঙ্কর বিষয়গুলোতেও সে খুব একটা বিচলিত হয় না, যদিও কিছু সময়ের জন্য তাকে নিশ্চুপ পাওয়া যায়, কিন্তু কিছু পরেই ফিরে আসে কিশোরীর উৎফুল্লতা।ল্পীর এই চাঞ্চল্যতা কে যে মানুষটা সবচাইতে বেশি অপছন্দ করত সে শিল্পীর খালাতো ভাই, ফারুক। সেই ছো থেকেই সে শিল্পীকে দেখছে, কিন্তু শিল্পীর এরকম বেহাইয়াপনা আচরন তার কখনই ভাল লাগত না বিশেষ। শিল্পীর দুই বছরের বড় ছিল ফারুক, তবুও শিল্পী বড় ভাই হিসেবে ফারুককে সম্মান করত না খুব একটা। ফারুককে তুই তুই করে ডাকতো। শাহানা খালা কষ্ট পাবে বলে ফারুক কখনো কোন অব্জেকশনও তুলে নি, কিন্তু সে প্রচন্ডভাবে এই ব্যাপারটাকে অপছন্দ করত। আর শিল্পীকেও।কিরে তুই এইচ এস সি দিছস ! খবর কি ? রেজাল্ট তো দিল।খবর তো জানসই, আমার জিগাস ক্যান?জানি না আমি, কেউ বলে নাই তো। অবশ্য বলতে পারলে তো বলবে।-তুই আমার ঘরের থেকে বের হ – তোর ঘর ? ? এটা আমার খালার বাসা। তোর কথা মত যাইতে হবে না কি?-তোরে বের হইতে বলছি তুই বের হ। এই বাসায় আর আসবি না। লজ্জা থাকলে বের হ, যাবেশি ভাব কোন সময়ই ভাল না।তুই বের হফারুক শাহানা বেগমের বাসা থেকে আস্তে বের হয়ে যায়। সে আজকে অপমানিত হয়েছে ঠিক কিন্তু তা নিয়ে ফারুককে খুব একটা বিচলিত হতে দেখা যায় না। সে মনে মনে এক ধরনের আনন্দও পাচ্ছে। আনন্দের কারন শিল্পী ফেল করেছে। এরকম অহংকারী মেয়েদের ফেলই করা উচিত। যারা বড় কাউকে সম্মান করতে পারে না, মানুষকে কষ্ট দেয় তাদের সাথে এরকম হওয়াই উচিত। শিল্পী ফেল করাতে ফারুকের অন্য একটা খুশির কারন ছিল ফারুক নিজেও আই এ পাস। শিল্পী এই আই এ পাস টা করে ফেললে হয়ত তার দেমাগের ধাক্কায় আর বাচা যেত না। যাই হোক, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।ফারুক, তোর একটা বন্ধুরে দেখলাম যে, ওইটা কে রে?-রাহাত?-আমি তো আর নি না, ওই যে ওই দিন তোর সাথে ছিল যে, তোর অফিসে দেখছিলাম।-ও আচ্ছা, ওর নাম রাহাতই।-হুম্ম, পোলাটা কি করে রে?-কি করব? চাকরি করে।-কিসে?-সরকারি চাকরি। এলজিডির বড় অফিসারের সাথেই থাকে সবসময়। এলজিডির সব কাজের জন্য ওর হাত লাগে, কোটি কোটি টাকার কাজ ওর হাত দিয়া যায়।-অহ, পোলাটা দেখতে শুনতেও ভাল দেখলাম।-হুম, ভালই। বাপ মা’র এক ছেলে। ভাল খুব।-আচ্ছা ওর সাথে শিল্পীর , বুঝছসই তো বাবা। মাইয়াটা আমার……………-কিন্তু খালা……এই ধরনের ইনিকুয়ালিটির ব্যাপার স্যাপার ফারুককে বেশ বিরক্ত করত। যেখানে রাহাত বাবা – মায়ের এত বড় ছেলে, মোটামুটি একটা চাকরিও করে, সরকারি চাকরিতে পোস্ট যেমনই হোক, অবস্থা বেশ ভালই হয়, তাছাড়া রাহাতের কিছু ক্ষেত্রে সাইনও অনেক বড় ব্যাপার। এরকম একটা ছেলেকে শিল্পীর মত মেয়ের জন্য ভাবাটাও তো দুঃসাহস। যেখানে শিল্পীর চেহারা বাদ দিলেও আচার আচরণ সব কিছুই মূর্খের মত , পুরুষ মানুষ দেখলে ঢুলে পরে তার স্বভাব। অথচ এই দুঃসাহসের ব্যাপারটাই ইদানিং দেখাচ্ছেন শাহানা বেগম। কারন এখন দুঃসাহস ছাড়া তার গতি নাই আবার দুঃসাহসেও গতি নাই। ফারুক খালার মুখের সামনে বিশেষ কিছু বলতেও পারে নি।-কিরে ফারুক, রাহাতের কি অবস্থা? কিছু কইছিলি?-নাহ , আমি কি কমু? আমনে এগুলা কি বলেন? রাহাত কত কোয়ালিফাইড, এডুকেটেড একটা ছেলে। এটা হয় না কি!-আমার মাইয়ারে যারা দেখতে আসছে তারা কেউই কি কম ছিল না কি?-দুষ্ট গরু দিয়া ভরা গোয়াল আর কি। এগুলা কইয়া এখন কি লাভ খালা। আর আপনার মেয়ের স্বভাবও তো খুব একটা ভাল না। সে সারাদিন ফোনে এত কি করে? আপ্নেও তো ডাক দেন না, ঠিক কইরা ডাক দিলে আজকে এরকম হইত না।শাহানা বেগম আর কিছুই বললেন না, ফারুক বাকি যতটা সময় ছিল শাহানা বেগম চুপ করেই ছিলেন। তার বলার মতন কিছুই ছিল না। মেয়েটাকে যে খুব একটা মানুষ করতে পারে নি সে সেটাও বুঝতে পারছে ভালভাবেই।শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহে শিল্পীর ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল। বিষয়টা খুব একটা এগিয়েই ছিল। ডাক্তার বলেছিল তার পক্ষে বেশিদিন বাঁচা সম্ভব না। বেশি হলে তিন বছর। হাসপাতালের বিছানায় অনেক রোগীর মত তাকেও একটা বিরাট কক্ষে খাটের উপরে রাখা হয়েছে। প্রায়শই তার শরীর খারাপ করে। সপ্তাহে অন্তত একবার রক্ত পালটানোর দরকার হয়, আরও যাবতীয় কাজ ছিল।কোন এক শ্রাবণ মাসেই শিল্পীর মৃত্যু হয়েছিল, ব্রেন টিউমারের কারনে। গল্প লেখকদের শ্রাবণ মাসের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ আছে। সে কারনেই গল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো হয় শ্রাবণ মাসে। আকাশে তখন থাকে কালো মেঘ। হটাত সব কিছু অন্ধকার হয়ে ঘনিয়ে আসে। এরপরেই শুরু হয় মেঘের গর্জন। তারপর ঝুম বৃষ্টি। কালো মেঘের মতন জীবনের অংশগুলোও মলিন হয়ে যায়। কখনো কখনো ঝর হলে তো সব কিছুই লন্ডভন্ডও হয়ে যায়।তবে সেই শ্রাবনের মেঘ ঘনাবার আগে কতগুলো সুন্দর ঘটনাও ঘটেছিল। ফারুকের সাথে বিয়ে হয় শিল্পীর। ফারুক ছেলেটা আগে থেকেই ভালবাসত শিল্পীকে। সেই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়ত ছিল শিল্পীর বিয়ে ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে। ব্রেন টিউমারের পরে শিল্পী বেশিরভাগ সময়ই সেই লুকোচুরি খেলা ছেলেটাকে বারে বারে দেখতে পেত। হয়ত তার একাকীত্বের জন্য সেই মানুষটা বারে বারে সপ্নের মাঝে এসে ভিড় করত। প্রতিদিন মনে হয় সপ্নের মানুষটা আরও বেশি কাছে এসে পড়ছে। অনেকটা কাছে, আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে আসছে তার চেহারা।ফারুকের ব্যাবসার থেকে মন গিয়ে পরে থাকত শিল্পীর কাছে। যাকে সে দেখতে পারত না হটাত করে তার জন্যই খারাপ লাগতে শুরু করে। শত হোক, মেয়েটা আর কদ্দিনই বা বাঁচবে। তার উপরে জেদ ধরে থেকে কি লাভ। ফারুক ১ সপ্তাহের জন্য ব্যাবসা বাদ দিয়ে খালার বাড়ি চলে আসে। সবার ভাবনার তোয়াক্কা না করে সে শিল্পীর সাথে সাথে থাকত। শিল্পীর সাথে কত ধরনের অদ্ভুত সব গল্প করে বেড়াত। কোন এক শুক্রবারে হটাত সে শিল্পীকে নিয়ে বের হয় ঘুরবার জন্য। এরপরে তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। এই টাইপের রোগীরা বিশেষ করে সে যখন মেয়ে হয় তার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চায় না, কিন্তু সে না চাওয়াটা খুব একটা জোরালো হল না যখন সপ্নের সেই বোকা ছেলেটার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠা শুরু করে।ফারুক আর শিল্পীর একটা বাচ্চা হয়। তারা অনেক ভেবে তাদের ছেলের নাম রেখেছিল প্রকৃতি। নামটা মানুষের নাম হিসেবে চমৎকার রকম অদ্ভুত ছিল। প্রকৃতি সত্যই অদ্ভুত। সে সবসময় চায় এক ধরনের সেলফিশ জীনকে বাচিয়ে রাখতে। সে কখনো সেটাকে নষ্ট হতে দিতে চায় না। হয়ত তাদের বহন করা আর কপি করাই আমাদের চূড়ান্ত আর চরমতম উদ্দেশ্য। আর এ কারনেই গল্পের মৃত্যুপথযাত্রি মেয়েটা হটাত করে তার সপ্ন পুরুষ হিসেবে দেখতে পায় সবচাইতে অপছন্দ করা কাউকে। আর ছেলেটাও হটাত করে অসহায়ভাবে পাগল হয়ে যায় সেই ভ্যাপসা রঙের মেয়েটার প্রতি, যে একসময় পাড়ার ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নানান রকম ছ্যাস্রামি করে বেড়াত।